জয়, জয়...সিরিজ জয়

সমালোচনার সব জবাব দিয়েছিলেন আগের ম্যাচেই। কালকের সেঞ্চুরিতে তামিম ইকবালের ছিল শুধুই প্রাপ্তির আনন্দ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পর বাংলাদেশের জয়ের নায়কের মুখে সেই অর্জনেরই আভা l ছবি: শামসুল হক
সমালোচনার সব জবাব দিয়েছিলেন আগের ম্যাচেই। কালকের সেঞ্চুরিতে তামিম ইকবালের ছিল শুধুই প্রাপ্তির আনন্দ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পর বাংলাদেশের জয়ের নায়কের মুখে সেই অর্জনেরই আভা l ছবি: শামসুল হক

আনন্দ যা হলো গ্যালারিতেই! সাকিবের ব্যাটে জয়সূচক রানটি আসতেই সেখানে তুমুল হর্ষধ্বনি। এর পর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ গর্জন। জয়ের সুবাস পেয়ে বাংলাদেশের ইনিংসের মাঝামাঝি স্টেডিয়ামে ছুটে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে লাল-সবুজ পতাকা দোলাতে শুরু করলেন। মুখে মৃদু হাসি।

কিন্তু মাঠে আবেগের প্রকাশ কই! জয়ের পর বাতাসে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়া নেই। ‘নিয়ম’ অনুযায়ী দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান সাকিব ও তামিম পরস্পরকে আলিঙ্গনে পর্যন্ত বাঁধলেন না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাঁরা পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
একসময় নিয়ম তো এটাও ছিল যে, এমন একটা জয়ের পর বাকি খেলোয়াড়েরা বাউন্ডারি লাইনের বাইরে থেকে আনন্দে উন্মাতাল দৌড়ে মাঠে ঢুকে পড়বেন। অথচ তাঁরা মাঠে ঢুকলেন ধীর পায়ে। দু-তিনজন দৌড় লাগালেন বটে, সেটি জয়ের স্মারক স্টাম্প তুলে নিতে। কে বলবে, একটু আগেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে গৌরবের আরেকটি অধ্যায় লেখা হয়ে গেছে!
ষোলো বছর যে দলকে হারানো যায়নি, তাদের তিন দিনের মধ্যে দুবার হারিয়ে সিরিজ জিতে নেওয়ার এমন নিরুত্তাপ উদ্যাপন! ৭১ বল বাকি রেখে ৭ উইকেটে জয় মানে প্রতিপক্ষকে রীতিমতো উড়িয়ে দেওয়া। সেটির পরও আনন্দের বাঁধভাঙা প্রকাশ নেই! না, আসলেই বদলে গেছে বাংলাদেশ দল!
সিরিজ শুরুর দিন পনেরো আগেই বাংলাদেশকে ফেবারিট ঘোষণা করে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বাস করেন বলেই বলেছিলেন। তবে এতটা কি তিনিও ভেবেছিলেন! ভেবেছিলেন, আগে ব্যাটিং বা পরে ব্যাটিং তাতে কিচ্ছু আসবে যাবে না। প্রথম দুই ম্যাচে জয়ের মধ্যে কোনটি বেশি দাপুটে, এ নিয়ে তর্ক হবে। এবং ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচের আগে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে একটাই-আবারও একটি ‘বাংলাওয়াশ’ হবে কি না?
নয় বছর আগে বগুড়ায় শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা এমন উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলেন যে, কোচ ডেভ হোয়াটমোর ভীষণ রাগ করেছিলেন। সেই বাংলাদেশেরই এত বছর অবধ্য পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জেতার পরও ‘এ আর এমনকি’ ভঙ্গিটা ব্যাটে-বলে দাপটের চেয়েও বড় একটা বার্তা ছড়িয়ে দিল। এই দল কোনো কিছুই অসম্ভব বলে মনে করে না। এটাই বা কে কবে ভাবতে পেরেছিলেন, এমন একটা সাফল্যের পর বাংলাদেশ অধিনায়ক পুরস্কার বিতরণীতে বলবেন, ‘আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। একটা ম্যাচ এখনো বাকি।’
জয়সূচক রানটা যে সাকিবের ব্যাট থেকে এল, চাইলে এটারও একটা প্রতীকী অর্থ করে নিতে পারেন। নিজেদের ফেবারিট দাবি করে দলে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা তো তিনিই শুরু করেছিলেন। তবে ম্যাচের নায়ক অবশ্যই সাকিব নন। আগের ম্যাচে নায়কের আসনে পাশাপাশি জায়গা দিতে হয়েছিল দুজনকে। এদিন সেই সিংহাসনে শুধুই একা তামিম ইকবাল।
প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পাওয়া মুশফিকুর রহিম কালও যথেষ্টই উজ্জ্বল। ৭০ বলে ৬৫ রানের ইনিংস। তামিমের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে তাঁর ১১৮ রানের জুটিটিই ম্যাচ থেকে অনিশ্চয়তার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দিয়েছে। মুশফিক যখন আউট হলেন, জয়ের সঙ্গে দূরত্ব ২২ রানের। যা করতে মাত্র ১১ বল লাগল। ওই ২২ রানের ১৪-ই এল তামিমের প্রমত্ত ব্যাট থেকে। মাত্র ৬ বলে।
ছন্দে থাকা তামিমের ব্যাটিং ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ত্রিনিদাদের ওই ম্যাচ ফিরিয়ে আনে বারবার। জুনাইদ খানকে ডাউন দ্য উইকেট গিয়ে সোজা যে ছক্কাটি মারলেন, সেটিও যেন ত্রিনিদাদে জহির খানকে মারা ছক্কাটির রিপ্লে। টিভি কমেন্ট্রি বক্সে বসে যা দেখে রীতিমতো মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন আমির সোহেল।
ইমরান খান আমির সোহেলকে ১৯৯২ বিশ্বকাপের দলে নিয়েছিলেন তাঁর ভয়ডরহীন ডাকাবুকো মানসিকতা দেখে। তাঁর মতোই আরেক বাঁহাতি ওপেনারের মধ্যে সেই প্রতিচ্ছবি দেখে সোহেল তো মুগ্ধ হবেনই। এর মধ্যেও হতাশার সুরে বললেন, ‘এই সিরিজ দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে আর পাকিস্তান ক্রিকেট কতটা খারাপ হয়েছে।’
‘দেখিয়ে দেওয়া’র কথা বললে অবশ্য তামিম ইকবালের মতো করে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আর কেউ তা দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সেই বিশ্বকাপ থেকেই এ দেশের আমজনতার মতো তথাকথিত ক্রিকেটবোদ্ধারাও পেছনে লেগে গিয়েছিলেন তাঁর। সেটির ঢেউ গিয়ে পড়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও। প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরিতেই জবাব দিয়েছেন। শুধু ব্যাটেই নয়, উদ্যাপনেও। কাল জবাবটা শুধু ব্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ রাখলেন। শাহরিয়ার নাফীস ও মাহমুদউল্লাহর পর বাংলাদেশের মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরির আনন্দ বাঁধভাঙাই হওয়ার কথা। শুধু সেই আনন্দের নির্ভেজাল প্রকাশই থাকল কালকের উদ্যাপনে।
শুধু ম্যাচ শেষ করে বেরিয়েছেন বলেই নয়, স্ট্রোক প্লের দ্যুতিতেও তামিমের কালকের ইনিংসটি তুলনায় অনেক বেশি ঝলমলে। পেছনে সেঞ্চুরির আত্মবিশ্বাস তো অবশ্যই একটা কারণ। প্রথম ২৪ বলে করেছিলেন ২৭ রান। পরের সাত বলে দেখা দিলেন ‘সাহসী সুন্দর’ সেই তামিম ইকবাল। প্রথম ওয়ানডেতে অত সব চোখধাঁধানো শটের মধ্যেও সাঈদ আজমলের এক ওভারে দুটি চার ও একটি ছয় আলাদা করে মনে রেখেছিলেন। কাল সেই আজমলকে পরপর তিন বলে চার। পরের ওভারে ওয়াহাব রিয়াজের বলেও টানা তিন চারে ফিফটি। মাত্র ৩১ বলে। এর আগে ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারেও রাহাত আলীর চার বলে মেরেছেন ৩টি চার।
সেঞ্চুরি এল ১০৮ বলে, যাতে চার ১৬টি। সেঞ্চুরির পর আরও একটি চার ও জুনাইদের বলে মারা ওই ছক্কা। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা এমন একতরফা বানিয়ে ফেলার কৃতিত্বটা তামিম আর মুশফিকের বলেই ম্যাচ রিপোর্টে এখনো বাংলাদেশের বোলারদের দেখা নেই। তবে পাকিস্তানকে ২৩৯ রানে আটকে দিয়ে জয়ের ভিত্তিপ্রস্তর তো স্থাপন করেছেন তাঁরাই। ব্যাটিংয়ে যেমন বাকি সবাইকে ছাপিয়ে তামিম ইকবাল, বোলিংয়ে তা নয়। সেটি ‘সবে মিলি করি কাজ’-এর আদর্শ উদাহরণ। হাত ঘুরিয়েছেন সাতজন বোলার। ৬টি উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তাঁদের পাঁচজন।
৭৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর পাকিস্তানের ২৩৯ পর্যন্ত যাওয়াটা সাত আর আট নম্বর ব্যাটসম্যানের দুই ফিফটিতে। অতীতে অনেকবারই পাকিস্তানি বোলাররা এমন স্কোরকেও ‘অনেক বড়’ বানিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু এদিন তাঁরা অসহায়। তামিম তামিমের মতো খেললে অমন অসহায়ত্বের অনুভূতিতে বিমূঢ় হয়ে যাওয়াটাই যে বোলারদের নিয়তি!

পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ২৩৯/৬
বাংলাদেশ: ৩৮.১ ওভারে ২৪০/৩
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী