মেসি-রোনালদো বিতর্কটা চলুক না!

ফুটবলের দুই সর্বকালের সেরা প্রতিভার লড়াই উপভোগ করার সৌভাগ্য হচ্ছে আমাদের! ফাইল ছবি
ফুটবলের দুই সর্বকালের সেরা প্রতিভার লড়াই উপভোগ করার সৌভাগ্য হচ্ছে আমাদের! ফাইল ছবি

দৃশ্য এক: সতীর্থের গোল উদ্‌যাপনে সঙ্গী না হলে নির্লিপ্ত থাকা তাঁর জন্য নতুন নয়। এর জন্য সমালোচনাও শুনেছে​ন ঢের। কিন্তু আলমেরিয়া ম্যাচে যা করলেন, একেবারে অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য। আরবেলোয়ার গোলে ৩-০তে এগিয়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদ। সতীর্থেরা আরবেলোয়াকে জড়িয়ে উদ্‌যাপন করছে। আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো? তিনি যেন রাগে ক্ষোভে গোলপোস্টের জাল ছিঁড়ে ফেলবেন। সব রাগ বেচারা বলটার ওপর ঝেড়ে লাথিও কষলেন! আরবেলোয়ার দিকে ফিরেও তাকালেন না। গোলটা যে তিনিও দিতে পারতেন!

দৃশ্য দুই: গতকাল করদোবার বিপক্ষে খেলছে বার্সা। ম্যাচের ৮৫ মিনিট। বার্সা ৬ গোল দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, গোলদাতার​ তালিকায় রাকিটিচ, এমনকি পিকের নামও আছে, নেই নেইমার! ঠিক তক্ষুনি পেনাল্টি পেল বার্সা। মেসির নামের পাশে তখন জোড়া গোল। পেনাল্টিটা নিলে হ্যাটট্রিক হয়। স্প্যানিশ লিগের পয়েন্ট টেবিলের মতো পিচিচি ট্রফির পুরস্কারটার জন্যও রোনালদো-মেসির জমজমাট লড়াই চলছে। এই ম্যাচেই রোনালদোকে টপকে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় উঠেছেন মেসি। রোনালদোকে টপকে যাওয়ার সুযোগ ছিল স্প্যানিশ লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটাতেও।
আগের ম্যাচেই খেলোয়াড়দের জন্য স্বপ্নের পানেনকা পেনাল্টিতে গোল করে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া মেসি পেনাল্টিটা নিলেন না। অনেককেই চমকে দিয়ে বল তুলে দিলেন নেইমারকে। মাত্র ৫ মিনিট আগে নেইমারকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই একটা গোল করেছিলেন বলেই হয়তো বললেন, ‘নাও, এবার তোমার পালা।’ সবচেয়ে বড় কথা, কাল নেইমার ঠিক নেইমারের মতো খেলছিলেন না। কদিন পরেই চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বায়ার্ন-পরীক্ষা। একটা গোল নেইমারকে ফিরিয়ে দেবে আত্মবিশ্বাস। করদোবার বিপক্ষে বার্সার ৮-০ গোলের জয়, লুইস সুয়ারেজের দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল এই ছবিটাই—হ্যাটট্রিকের সুযোগ পেয়েও, রোনালদোর সঙ্গে ব্যক্তিগত লড়াইটার তীব্রতম পর্যায়ে থেকেও মেসি একটা গোল ছেড়ে দিলেন সতীর্থকে।
দুটো দৃশ্য আঁকার বিপদ হলো, মেসি-রোনালদো সমর্থকদের মধ্যে আরেকটা বিতর্ক উসকে দেওয়া। কিন্তু কোনো দিনও শেষ হওয়ার নয় এমন বিতর্কে না যেয়ে বরং এটাই মেনে নেওয়া ভালো, মেসি মেসির মতো, রোনালদো রোনালদোর মতো। যেমন ছিলেন ফর্মুলা ওয়ানের সত্তরের দশকের দুই তীব্রতম প্রতিপক্ষ জেমস হান্ট আর নিকি লাউডা। হান্ট ক্ষুধার্ত বাঘ যেন, কোনো কিছুতেই পরোয়া নেই। গ্ল্যামার আর প্লেবয় ভাবমূর্তিতে উজ্জ্বল। ঠিক উল্টো ছবি লাউডা। শৃঙ্খলা, নীতির ​বৃত্তে থাকা। চরিত্রের দিক দিয়ে দুই মেরুর হলেও সবচেয়ে বড় মিল ছিল, প্রতিভার দিক দিয়ে দুজনই ছিলেন সর্বকালের সেরা। দুজনই বের করে আনতেন দুজনের সেরাটা।
আর এ কারণেই ১৯৭৬ সালের ফর্মুলা ওয়ান মৌসুমটি ইতিহাসে সেরা হয়ে আছে। যেমন ফুটবলে সেরা সময় হয়ে থাকবে গত কয়েকটা মৌসুম। কী আশ্চর্য জানেন, সেবারের ফর্মুলা ওয়ানের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লাউডা শেষ রেসে অংশ ​নিয়েও কয়েক ল্যাপ শেষে নিজে থেকেই থেমে যান। মাত্র কয়েক দিন আগে ভয়ংকর দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন। না, মৃত্যু ভয়ে নয়। লাউডা রেসে অংশ নেননি, কারণ তাঁর কাছে নীতিটাই আসল, যে নীতিতে তিনি মনে করেন, চালকদের কখনোই ২০ শতাংশের বেশি ঝুঁকি নিতে নেই। তাদেরও তো পরিবার আছে।
হান্ট এসবের পরোয়া করেন না। মৃত্যুকে মুঠোয় পুরে নিতে কোনো পরোয়া নেই তাঁর। ওই যে, সাফল্যের জন্য অসম্ভব ক্ষুধা। আর সেই ক্ষুধাটাই নাটকীয়ভাবে সেবার ফর্মুলা ওয়ান জিতিয়ে দেয় তাঁকে।
এ নিয়ে রাশ নামের অসাধারণ একটা চলচ্চিত্র আছে। যে চলচ্চিত্রের শেষ দিকে দেখা যায়, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোজকার মতো ঝাঁজ নিয়ে বাক্য বিনিময় করতে করতেই স্বীকার করে নিচ্ছেন, তাঁরা দুজন দুজনের যতটা ‘শত্রু’, তার চেয়েও বেশি যেন বন্ধু। লাউডা মৃত্যুর মুখ থেকে লড়াই করার অসম্ভব মানসিক সাহস, কিংবা জেদই বলা ভালো, পেয়েছেন তাঁর অনুপস্থিতিতে টিভিতে হান্টকে একের পর এক গ্রাঁ প্রিঁ জিততে দেখে। সবাই যাঁর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, সেই লাউডা​ সেই মৌসুমেই ট্র্যাকে ফিরে এসেছিলেন শুধু হান্টকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন বলে। আর হান্ট প্রবল বৃষ্টি মধ্যেও জীবনকে মুঠোয় পুরে গাড়ি ছুটিয়েছেন, কারণ লাউডাকে তিনি প্রমাণ করে দিতে চান, তিনিও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে জানেন।
আশ্চর্য চিত্রনাট্য মেনে মেসি যে রাতে হ্যাটট্রিকটা মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিলেন, সেই রাতেই রোনালদো অবিশ্বাস্য এক হ্যাটট্রিক করলেন। সেটাও এমন এক দলের বিপক্ষে, নিজেদের মাঠে যারা অজেয় বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। বার্সাকেও ছাড় দেয়নি। সেই সেভিয়া-পরীক্ষায় রিয়াল ব্যর্থ হলে লিগ শিরোপার দৌড় থেকেই ছিটকে পড়ত। আগুন-পরীক্ষার সেই ম্যাচে রোনালদোর হ্যাটট্রিক! এই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় আবার মেসিকে পেছনে ফেলা। লিগের হ্যাটট্রিক সংখ্যাতেও!
এ যেন ফুটবলের হান্ট আর লাউডার ফর্মুলা ওয়ান রেস! যার ফলাফল, রোনালদো রিয়াল নাম লিখিয়ে একই ‘ট্র্যাকে’ আসার পর তাঁর নামের পাশে ছয় মৌসুমে ৩০৫ গোল, মেসির নামের পাশে ৩২৫। কী অবিশ্বাস্য ফুটবল উপহার দিয়ে চলেছেন দুজনে! কী সুন্দর সেই লড়াই! কদর্য রূপ না দিয়ে সমর্থকদের মধ্যেও একটা ‘সুন্দর’ লড়াইটা তো চলতেই পারে। চলুক না!
রাশ-এর শেষ সংলাপটা নিকি লাউডার। হান্ট সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘মানুষ সব সময় আমাদের শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীই ভাবত। কিন্তু সে সেই স্বল্প মানুষদের একজন ছিল যাকে আমি পছন্দ করতাম, সে সেই স্বল্পতম মানুষদের একজন ছিল যাকে আমি সম্মান করতাম। সে-ই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, যাকে আমি ঈর্ষা করতাম!’