বদলে যাওয়া এক তামিম

সাড়ে তিন বছর টেস্টে সেঞ্চুরি নেই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চলতি দ্বিতীয় টেস্টে দু-দুবার সুযোগ পেয়েও কাটেনি বন্ধ্যাত্ব। নিশ্চয়ই খুব হতাশ...। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটাকে শেষও করতে দিলেন না তামিম ইকবাল। তার আগেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে কেন? এর কারণে আমারই ক্ষতি হচ্ছে। এটা আপনাদের বোঝা উচিত। এতবার একটা প্রশ্ন করা উচিত না। সবকিছুর একটা লিমিট আছে। প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক দিনই দেখা হলে এই এক প্রশ্ন—সেঞ্চুরি হচ্ছে না...।’

টেস্টে এত দিন ধরে সেঞ্চুরি না পাওয়ার জ্বালাটা যে তামিমেরই সবচেয়ে বেশি, সেটা কে না বোঝে? প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তামিমের ও রকম ফুঁসে ওঠাতে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার। সংবাদ সম্মেলন থেকে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে আরেকটু ভেঙে বললেন রেগে যাওয়ার যুক্তিটা, ‘দেখেন, সেঞ্চুরি করতে কে না চায়। আপনারা হয়তো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে প্রশ্ন করেননি, তবে আমার জন্য তো পরিস্থিতিটা সে রকমই। দেখা হলে সবাই এই এক কথা বলে।’

ক্রিকেট যত না ব্যাট-বলের খেলা, কখনো কখনো বেশি মানসিক। তাতে জয়-পরাজয় দুটোই আছে। ২০১০ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডের পর সাড়ে তিন বছরে টেস্টে আর সেঞ্চুরি না পাওয়া হয়তো তামিমকেও সে রকম পরিস্থিতির সামনেই দাঁড় করিয়েছে। নইলে উইকেটে আঁকড়ে পড়ে থাকা ইনিংসগুলোতে কখনোই সেঞ্চুরি আসেনি মনে করিয়ে দিতেই আবারও কেন জ্বলে উঠবেন তেলে-বেগুনে? ‘যদি মেরে খেলি, সবাই বলে আমি মেরে খেলি। আমি ধীরে ব্যাটিং করলে সবাই বলে আমি ধীরে ব্যাটিং করি। আমি আসলে করবটা কী, এটা আপনারাই আমাকে বলে দেন। এ জিনিসটা এত অতিরিক্ত হচ্ছে যে আমি স্বাভাবিক খেললেও বলে আমি মেরে খেলছি। আস্তে খেললে বলে আস্তে খেলছি। সমস্যাটা কী বলেন? লেট মি প্লে মাই গেম প্লিজ’—ক্ষুব্ধ তামিম এর পর যোগ করলেন, ‘আল্লাহর রহমত যে, শেবাগ বাংলাদেশে জন্ম নেয়নি। তাহলে ও ক্রিকেট খেলা ভুলে যেত। মিডিয়াও ক্রিকেটের অংশ। কিন্তু একটা জিনিস নিয়েই বারবার বলাটা ক্রিকেটের অংশ বলে আমি মনে করি না।’ 

অথচ কালকের দিনটা তামিমের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশের দিন ছিল না। দলের প্রয়োজনে এদিন তিনি ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকেও! মারকুটে তামিমের ২১৮ বলে মাত্র ৭০ রান করাটা অবিশ্বাস্য হলেও ম্যাচের পরিস্থিতি ওই সময় তাঁর কাছে এই ব্যাটিংই দাবি করছিল। টেস্টের প্রায় দুই দিন বাকি। এক দিকে মমিনুল চালাচ্ছিলেন। আরেক দিকে তামিমও যদি তেড়েফুঁড়ে খেলতেন, চতুর্থ দিনটা এত ভালো নাও যেতে পারত দলের জন্য। তাহলে সেঞ্চুরি করা না-করা নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? আসলে তামিমের হতাশাটা বুঝতেই ওই প্রশ্ন, তাঁকে আক্রমণ করতে নয়। আবেগাক্রান্ত তামিমই হয়তো ভুলভাবে নিয়েছেন প্রশ্নগুলোকে।

সংবাদ সম্মেলনে উত্তেজিত থাকলেও টেস্টের ব্যাটিং আসলে কেমন হওয়া উচিত, তামিমের কালকের ইনিংস সেটির একটি প্রামাণ্য। সেঞ্চুরিই তাঁর লক্ষ্য ছিল না, ‘এই ইনিংসটা ছিল দলের জন্য। আমার নিজের কোনো লক্ষ্য ছিল না। আমি ১০০ করব, ৮০ করব এমন কিছু না। হ্যাঁ, আমি কিছুটা হতাশ। ১০০ করা উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি।’ তামিম অবশ্য স্বীকার করেছেন, স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাটিং করাটা সহজ ছিল না, ‘আমি স্ট্রোক খেলতে পছন্দ করি। একটা সময় অফ স্পিনাররা বল করছিল। আমার খুব প্রিয় একটা শট ওই সময় খেলিনি। প্রতিটি ইনিংস থেকেই আপনি কিছু না-কিছু শিখবেন। টেস্ট ক্রিকেটে এমন এমন পরিস্থিতি আসে যখন সেটা মেনে খেলতে হয়। আজকে (গতকাল) সে রকম পরিস্থিতিই ছিল।’

ব্যাটিং করেছেন দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘শুরুতে আমরা ব্যাকফুটে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল, যত কম উইকেট হারিয়ে যত বেশি সময় ব্যাট করা যায়। ভেবেছিলাম আমরা যদি সারা দিনে দুই-তিন উইকেটও হারাই, এরপর কাল (আজ) যদি ৪০-৫০ ওভার ব্যাটিং করি, আমাদের মুশফিক আছে। নাসির আছে। সবাই দ্রুত রান করতে পারে। আর ওদের ১০টা উইকেট নিতে কিন্তু দশটা বলই লাগবে। কাজেই যেকোনো কিছু হতে পারে।’ পরিকল্পনা কাজে লাগায় ঢাকা টেস্ট এখন রং বদলে সে রকম সম্ভাবনাও জাগিয়েছে। তবে তামিম জানেন, ‘এটা ক্রিকেট। আমাদের যদি তাড়াতাড়ি দুটো উইকেট পড়ে যায়, পরিস্থিতি আবার অন্য রকম হবে।’

উইকেটে বেশি আক্রমণাত্মক থাকলেও মমিনুলকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেনই তামিমই। মমিনুলের ব্যাটিংয়ের প্রশংসাও করলেন, ‘যেভাবে ব্যাটিং করছে এটা আসলে স্বপ্নের মতো। ও কষ্ট করেছে অনেক। তারই সুফল পাচ্ছে। এত সাবলীলভাবে খেলতে বাংলাদেশের খুব কম ব্যাটসম্যানকেই দেখেছি।’

নিজের কথা না বললেও সাফল্যে আকাশে না ওড়ার পরিণতিবোধটা আছে তাঁরও। কাল যে হঠাৎই ও রকম আগুনে হয়ে উঠলেন, সেটা হয়তো ভেতরের হতাশা থেকেই। পেশাদার হিসেবে হয়তো তামিম একদিন সেটা গোপন করতেও শিখে যাবেন।