শেষ দিনের নাটকীয়তার অপেক্ষা

মমিনুলের হাতে ব্যাট নয় যেন জাদুর কাঠি। যার ছোঁয়ায় টেস্ট বাঁচানোর স্বপ্নটা এখন উজ্জীবিত। কাল মিরপুরে সেঞ্চুরির পর দর্শকের অভিবাদনের জবাবে মমিনুল ষ ছবি: শামসুল হক
মমিনুলের হাতে ব্যাট নয় যেন জাদুর কাঠি। যার ছোঁয়ায় টেস্ট বাঁচানোর স্বপ্নটা এখন উজ্জীবিত। কাল মিরপুরে সেঞ্চুরির পর দর্শকের অভিবাদনের জবাবে মমিনুল ষ ছবি: শামসুল হক

মিরপুরে টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে, নাকি ওয়ানডে! গ্যালারিভর্তি দর্শক। কখনো ‘তামিম...তামিম’ রব, কখনো মমিনুল হকের নামে স্লোগান। টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে এমন উত্তেজনা তেমন না গেলেও শেরে-বাংলা স্টেডিয়াম কাল সারাক্ষণই মাতোয়ারা ছিল দর্শক-উল্লাসে। তবে মমিনুলের পর পর দ্বিতীয় টেস্টে সেঞ্চুরির সঙ্গে পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে তামিম ইকবালের উইকেটে পড়ে থাকাকেও দর্শক যেভাবে স্বাগত জানাল, তাতে টেস্ট ক্রিকেটটাও তারা ভালো বোঝে বলেই মনে হলো।
প্রথম দুই দিনের বেশ খানিকটা সময় বৃষ্টিতে খেয়ে নেওয়ার পরও ঢাকা টেস্ট এখন শেষ দিনের নাটকীয়তার সামনে। ৪৩৭ রানে অলআউট হয়ে নিউজিল্যান্ড কাল প্রথম ইনিংসে লিড নেয় ১৫৫ রানের। তবে চতুর্থ দিন শেষে ১১৪ রানের লিড এখন বাংলাদেশের সামনেও জাগাচ্ছে ভালো কিছুর সম্ভাবনা। সেই ভালো কিছু প্রথমত টেস্ট ড্র, সম্ভব হলে জয়ও নয় কেন?
পিটার ফুলটন অবশ্য ভিন্ন মতাদর্শী। দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে এসে পঞ্চম দিনে টেস্টটা কীভাবে কীভাবে নিউজিল্যান্ডমুখী হতে পারে, সেই সমীকরণ দেখালেন, ‘ম্যাচে এখনো অনেক সময় বাকি। আজকের (গতকাল) মধ্যে আরও দুটি উইকেট ফেলতে পারলে ভালো হতো। তবে কাল প্রথম ঘণ্টায় যদি আমরা কয়েকটা উইকেট নিতে পারি, দারুণ জমে উঠবে খেলা।’
ফুলটনকে সত্যি প্রমাণ করে ম্যাচটা সত্যি সত্যি দারুণ হয়ে উঠলে বাংলাদেশের পক্ষে তার সিংহভাগ কৃতিত্ব দিতে হবে মমিনুলকেই। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৮১, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ২২। ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪৭ করার পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ১২৬ রান করে অপরাজিত। তাতে তামিমের পর টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান তো হলেনই, জন্ম দিয়েছেন আরও কিছু রেকর্ডেরও।
দুই টেস্টের সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান এখন মমিনুলের। কাল লাঞ্চের আগেই পেরিয়ে গেছেন ওপেনিং সঙ্গী তামিমের এই রেকর্ড। ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস ও ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে টানা দুই সেঞ্চুরি করা তামিম সেবার ২ টেস্টে করেছিলেন ২৬৮ রান। কাল লাঞ্চের আগেই চলতি সিরিজে মমিনুলের মোট রান ২৭০, দিন শেষে ৩৭৬। বাংলাদেশের পক্ষে এক সিরিজে তিন শর বেশি রান করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান তিনি। আজ আর মাত্র ৪ রান করলেই টপকে যাবেন তিন টেস্টের সিরিজে হাবিবুল বাশারের করা সবচেয়ে বেশি রানের (৩৭৯) রেকর্ডও। তবে সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে নির্বাচক হাবিবুল বাশারকে কালই একটা জায়গায় টপকে গেছেন মমিনুল। মাত্রই পঞ্চম টেস্ট খেলতে নেমে বাংলাদেশের পক্ষে এক সিরিজে সর্বোচ্চ ৫৪টি বাউন্ডারি মারার রেকর্ড এখন তাঁর। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজেই ৪৫টি চার মেরে আগের রেকর্ডটি করেছিলেন হাবিবুল।
এত এত রেকর্ডের জন্ম দেওয়া ইনিংসের বেশির ভাগ সময়ই মমিনুল সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন তামিমকে। দলের ৫৫ রানের সময় দ্বিতীয় উইকেট হিসেবে মার্শাল আইয়ুবের বিদায়ের পর তামিমের সঙ্গে ১৫৭ রানের জুটিটাও তৃতীয় উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন রেকর্ড। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই সিরিজেই ১৩০ রানের জুটিতে আগের রেকর্ডটি করেছিলেন জাভেদ ওমর এবং মোহাম্মদ আশরাফুল। এই টেস্টে মমিনুল আর কোনো রেকর্ডের জন্ম দেন কিনা, সেটা সময়ই বলবে। তবে দিন শেষে কাল সাকিবের (৩২*) সঙ্গে তাঁর চতুর্থ উইকেট জুটিটা অবিচ্ছিন্ন ছিল ৫৭ রানে।

১২৬ রানের ইনিংসে ১৬টি বাউন্ডারি মারলেও মমিনুলের ব্যাটিংয়ে তাড়াহুড়া ছিল না মোটেও। বরং শরীরী ভাষা দেখে মনে হচ্ছিল ব্যাটিং করার মতো সহজ কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। অবশ্য ৯৯ রানে পৌঁছে ১০০তম রানটি করতে মাঝে খেলেছেন ১০ বল। তাঁকে আটকাতে একপর্যায়ে অফসাইডে সাত ফিল্ডার রেখে বল করছিলেন বোল্ট আর ওয়াগনার। তবে ফিল্ডারদের কোনো সুযোগ না দিয়ে মমিনুল সেঞ্চুরিসূচক শটটি খেললেন ওয়াগনারকে স্ট্রেট ড্রাইভে চার মেরে।

দ্বিতীয় ইনিংসে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ‘হাইলাইটস’ যদি হয় মমিনুলের ব্যাটিং, তামিমের ৭০ রানের ইনিংসটাকে বলতে হবে বাংলাদেশের ইনিংসেরই মেরুদণ্ড। তামিম মানেই চার-ছক্কা, ডাউন দ্য উইকেটে তেড়ে আসা। কাল সেই তামিমই প্রমাণ করলেন, টেস্ট ক্রিকেটের আসল ব্যাটিংটাও তাঁর জানা। এমন নয় যে, উইকেট আঁকড়ে থাকা ব্যাটিং আগে কখনো করেননি। তবে কালকের ধৈর্যটা ছিল প্রকৃত অর্থেই দলের প্রয়োজনে। দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনেও তামিম বারবার বললেন, সেঞ্চুরির চিন্তা মাথায় ছিল না। ছিল কেবল টিকে থাকাটাই। পাশ থেকে মমিনুলকেও দিচ্ছিলেন একই মন্ত্রণা। তার পরও তামিমের সেঞ্চুরিটা হতে পারত। হলো না উইলিয়ামসনের বলে স্লিপে রস টেলরের এক হাতে নেওয়া দারুণ এক ক্যাচে।

প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের লিডটা যেন ১৬০ রানের মধ্যে থাকে, সকালে সেটাই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশি বোলারদের। দিনের চতুর্থ ওভারে ইশ সোধির রানআউট আর সপ্তম ওভারে রাজ্জাকের বলে ট্রেন্ট বোল্টের এলবিডব্লুতে সেই লক্ষ্য পূরণে পুরোপুরি সফল বাংলাদেশ।

বড় কিছু পেতে হলে আজও সবকিছুতে সাফল্যই চাইবে মুশফিকুর রহিমের দল। চাইবে গোটা দেশ।

বাংলাদেশ: ২৮২ ও ২৬৯/৩

নিউজিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৪৩৭