সৌম্যও কবিতা লেখেন, কলমে নয় - ব্যাটে

সাতক্ষীরার মাইলফলকের পাশে সাতক্ষীরার গর্ব। ছবি: জাহিদুল করিম
সাতক্ষীরার মাইলফলকের পাশে সাতক্ষীরার গর্ব। ছবি: জাহিদুল করিম

‘হৃদয়ে আজ আমার সৃষ্টির নান্দনিক উল্লাস/ চোখেমুখে বিশ্বজয়ের বিলাস/ নিরানব্বইয়ের ৩১ মের মধ্যরাতে/ হঠাৎ জেগে ওঠে একাত্তরের বাংলাদেশ।’

বাবা কিশোরীমোহন সরকার স্বরচিত কবিতা পাঠ করে চলেন, মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শোনেন সৌম্য সরকার। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক বিজয় স্মরণে কবিতাটি লিখেছিলেন কবি কিশোরীমোহন সরকার। অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁর আমরা যদি না জাগি মা বইয়ে।
কানে বাজতে থাকে কবিতার পঙ্‌ক্তি, চোখ আটকে থাকে বসার ঘরে সাজিয়ে রাখে বড় ডামি চেকের দিকে। এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে অপরাজিত ১২৭ রান করে ম্যাচ-সেরা হয়েছিলেন সৌম্য। এ তারই পুরস্কার। ১৬ বছর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই কাব্যিক জয় নিয়ে বাবা রচনা করেছেন কাব্য। ১৬ বছর পর ছেলের দুর্দান্ত ইনিংসে নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের কাব্যিক জয়। এবার আরেকটি কবিতা লিখবেন না? কিশোরীমোহন মৃদু হাসলেন। হয়তো বলতে চাইলেন, ‘কবিতা তো এখন আমার ছেলেই লিখছে—ব্যাটে!’
সৌম্যর বাড়িতে যাওয়ার আগে কথা দিতে হয়েছিল, সব নিয়ে কথা হবে, কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে নয়। প্রতিশ্রুতিটা রক্ষার চেষ্টা চলল। কিন্তু ঘুরে ফিরে ক্রিকেট উঁকি দিলই।
বাবার কবিতা কেমন লাগে? লাজুক উত্তরে সৌম্য বলেন, ‘ভাই, কবিতা বুঝি না।’ ছন্দ তাঁর শরীরে অন্যভাবে দোলা দেয়। সেটাই অনূদিত হয় ব্যাটের ভাষায়। চার-ছক্কায়। দুর্দান্ত কাভার ড্রাইভ, লং কিংবা মিড অনের ওপর দিয়ে বোলারদের আছড়ে ফেলায়।

গোধূলিলগ্নে প্রিয় জায়গা সাতক্ষীরার চাপড়ায় প্রথম আলোর ক্যামেরায় বন্দী হলেন সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম
গোধূলিলগ্নে প্রিয় জায়গা সাতক্ষীরার চাপড়ায় প্রথম আলোর ক্যামেরায় বন্দী হলেন সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম


নতুন গাড়ি কিনেছেন। সে গাড়িতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সারা দিনের যাত্রা শেষে ৯ আগস্ট রাত আটটায় পৌঁছেছেন সাতক্ষীরায়। এসেই বেরিয়ে পড়েছেন বন্ধু-বান্ধবের নিয়ে। সারা দিনের ধকলের পর সে রাতেই সাড়ে দশটায় মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। ক্লান্তির ছাপ চোখেমুখে। কিন্তু তবু মুখে লেগে থাকা সেই এক টুকরো হাসি। বাবার কাছ থেকেই জানা গেল, ছেলেবেলা থেকেই সৌম্য এমন। যেকোনো পরিস্থিতিতেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। সে হোক মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে। এ জন্যই তো চাপের মুখে ঠান্ডা মেজাজে খেলতে পারেন চোখ জুড়োনো সব শট।
ইদানীং আবার দারুণ সব ইনিংস খেলে বুকে হাত দিয়ে কী যেন দেখান। মনে হয়, যেন বোঝাতে চাইছেন, লাল-সবুজ আঁকা আছে এইখানে, এই বুকে। দেশের প্রতি সৌম্যের এ গোপন এক ভালোবাসা। সেটা গোপনই রাখতে চান বলেই উদযাপনের রহস্য খোলাসা করতে নারাজ। কথায় কথায় ক্রিকেটের প্রশ্ন উঁকি দেয়ই। সৌম্য ও বেশ বুঝতে পারেন। নিজ থেকেই বলেন, ‘ক্রিকেট বাদ থাকুক না। কটা দিন বাড়িতে এসেছি ঘুরতে। মায়ের হাতের রান্না খেতে। ক্রিকেট থেকে এখন দূরেই থাকতে চাই।’

বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দের স্মৃতি ধরে রাখতে সেলফি তোলায় ব্যস্ত সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম
বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দের স্মৃতি ধরে রাখতে সেলফি তোলায় ব্যস্ত সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম


সৌম্যকে পরিত্রাণ দিতে উঠতে হয়। বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় নিজ থেকেই প্রস্তাবটা দেন, ‘আপনাদের হাতে সময় থাকলে চলুন কাল বিকেলে খুব প্রিয় একটা জায়গায় ঘুরে আসি।’ সৌম্যের এমন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। পর দিন, সোমবার। বিকেলে হঠাৎ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি যখন থামল, দিনের আয়ু সাকল্যে এক ঘণ্টা। চট করে বেরিয়ে পড়তে হলো। গাড়ি নয়, দু চাকার বাইক। তিন বাইকে সৌম্যের সঙ্গী তাঁর বন্ধু মাহবুব সরদার, তাপস ঘোষ, এনামুল, অভি ও জিতু।
মিনিট চল্লিশের যাত্রা শেষে হঠাৎ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়া। জায়গাটায় পা রাখতেই অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করে মনে। চোখ যত দূর যায়, রাস্তার দুধারে দীর্ঘ জলরাশি। বর্ষায় উপচে পড়া জলে মাছের ঘেরগুলো রূপ নিয়েছে সমুদ্রে! সঙ্গে প্রাণ জুড়োনো বাতাস। গোধূলির এ সময়টাতে প্রকৃতি পায় অন্য রূপ। নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির কাছে। এ কারণেই সাতক্ষীরায় এলেই সৌম্য ছুটে আসেন শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরের এ জায়গাটাতে। 

বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে করে ঘুরতে বের হন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে স্টাইলিশ ক্রিকেটার সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম
বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে করে ঘুরতে বের হন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে স্টাইলিশ ক্রিকেটার সৌম্য। ছবি: জাহিদুল করিম

দুপাশের আদিগন্ত জলরাশিতে চোখ রেখে খানিকটা আনমনা হয়ে যান। যেন বাবার কবিসত্বা ভর করে ভেতরে। বলেন, ‘মন খারাপ থাকলে এখানে ছুটে আসি। জায়গাটা শান্ত, নিরিবিলি। সময়টা দারুণ কেটে যায়। গোধূলিটা বেশ উপভোগ্য। আকাশ-জলের এমন সন্ধি, দেখার আনন্দই আলাদা।’ 

রাস্তা দিয়ে সাঁ করে ছুটে যায় একের পর এক বাইক। কেউ কেউ হাঁক ছাড়েন, ‘আরও সেঞ্চুরি দেখতে চাই সৌম্য দা!’ ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার উপায় বুঝি নেই! সৌম্য মানলেন, এটাই স্বাভাবিক। বললেন, ‘বিশ্বকাপের আগে মানুষ হয়তো নামে চিনত। কিন্তু বিশ্বকাপের পর পুরো চিত্র বদলে গেছে। দেখলেই জটলা তৈরি হয়। ঠিকমতো ঘুরতে-ফিরতে পারি না।’
কোন জীবনটা বেশি উপভোগ্য? জাতীয় দলের খেলার আগে, না পরে? সৌম্যের জবাব, ‘একেক জীবন একেক রকম। তবে এখনকার জীবনই বেশি উপভোগ্য। সবকিছু না চাইতে পেয়ে যাই...’ হঠাৎ কথায় ছেদ ঘটে। সৌম্যকে ঘিরে ধরেছে ছোট্ট একটা জটলা। কাছেই মত্সকাঠি বাজার, এখানকার অন্যতম বড় মাছের বাজার। বাজারের লোকজন এক পলক দেখতে চায় সৌম্যকে। অনুরোধ, ফেরার সময় যেন একটু ঘুরে যান সেখানে। সৌম্য কথা দিলেন, যাবেন।
সূর্য ক্রমেই হারিয়ে যায় অদৃশ্য গহ্বরে। সঙ্গে নতুন প্রত্যাশার জন্ম হয় হৃদয়ে। নতুন দিনের আমন্ত্রণে সূর্য ফের উঠবে পুব আকাশে। মুগ্ধ নয়নে দেখেন সৌম্য। সেই চোখজোড়া প্রকৃতিপ্রেমী এক কবি-পুত্রের, বুঝতে অসুবিধা হয় না।