ভারতকে হারিয়ে সাফের মুকুট বাংলাদেশের যুবাদের

লাল–সবুজ পতাকা নিয়ে যুবাদের উদযাপন। টাইব্রেকারের নায়ক তখন সবার ওপরে। ছবি: আনিস মাহমুদ
লাল–সবুজ পতাকা নিয়ে যুবাদের উদযাপন। টাইব্রেকারের নায়ক তখন সবার ওপরে। ছবি: আনিস মাহমুদ

টাইব্রেকারের নাটকীয়তা। মাঠ ভর্তি দর্শকের আকাশ কাঁপানো গর্জন। সোনালি সুদিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে অনেক দিন পর বাংলাদেশের ফুটবলের সার্থক একটা ছবি আঁকল বাংলাদেশের আগামীর নায়কেরা। পেনাল্টি-ভাগ্যে ভারতকে ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নিল বাংলাদেশ। সিলেট থেকে ঢাকা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। সমগ্র বাংলাদেশ প্রাণভরে উপভোগ করল ষোলো বছর বয়সী যুবাদের ফুটবল-সুধা। 

সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে আজ দর্শকের ঢল নেমেছিল। ষোলো বছর বয়সীদের ফুটবল অথচ মানুষের কী আগ্রহ! মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল দেশের সাফল্যই। গোটা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন এই প্রজন্ম একটু একটু করেই গড়েছিল এই আগ্রহের ভিত্তি। গ্রুপ পর্বে ভারতকে ২-১ গোলে হারানোর পর দর্শক আগ্রহ আকাশ ছুঁয়েই যায়। একটি সাফল্যের জন্য এদেশের ফুটবলপ্রেমী দর্শকেরা যে কী অধীর প্রতীক্ষায় ছিলেন, তারও একটা চিত্র যেন ফুটে ওঠে সিলেটে আজকের ফাইনালে। মাঠের মধ্যে ছিলেন পঁচিশ হাজার দর্শক। মাঠের বাইরে ছিলেন আরও হাজার দশেক। গ্যালারিতে জায়গা না পেয়ে বিফল মনোরথে ঘরে ফেরা দর্শকেরা এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই দারুণ তৃপ্ত।
ফাইনালটা বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের জন্য ছিল স্বপ্নেরই। এর আগে একবারও এই প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠতে না পারা বাংলাদেশের জন্য আজকের এই খেলা ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জেরই। সেই চ্যালেঞ্জে দারুণভাবেই উতরে গেল বাংলাদেশের ফুটবলের আগামীর স্বপ্ন সারথিরা। সাদ উদ্দিন, মোহাম্মদ শাওন, ফাহিম মুর্শেদ, জাহাঙ্গীর আলম সজীবরা দর্শকের চাপ সামলে ঠান্ডা মাথার ফুটবলে চারদিকে ছড়িয়েছেন মুগ্ধতাই।
খেলার প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য। শুরুর দিকে বেশ কয়েক মিনিট ভারতীয় আক্রমণের ধারা বাংলাদেশের সীমান্তে আছড়ে পড়লেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদেরই গুছিয়ে দারুণভাবে ভারতকে চেপে ধরে বাংলাদেশ। একের পর এক আক্রমণে ভারতীয় রক্ষণব্যুহকে ব্যতিব্যস্ত করলেও কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখাটা বাংলাদেশ পায়নি। দুই হলুদ কার্ডের কারণে আজ মাঠে ছিলেন না দলের সেরা তারকা সারোয়ার জামান নিপু। তাঁর অভাবটা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই অনুভব করেছে বাংলাদেশ।
জামান নিপুর অনুপস্থিতির ফাঁক-ফোকর আজ দারুণভাবেই সামলেছেন সাদ উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম সজীব ও মোহাম্মদ শাওনরা। রক্ষণভাগে আতিকুজ্জামান ও খলিল ভূঁইয়ারা ছিলেন অবিচল। ভালো খেলেও প্রথমার্ধটা গোলশূন্য রেখেই সাজঘরে ফিরতে হয় বাংলাদেশকে।
দ্বিতীয়ার্ধে অন্য বাংলাদেশ দলকেই দেখে মাঠের দর্শকেরা। ভারতও ভড়কে যায় নতুন বাংলাদেশের আগ্রাসনে। দারুণ গতিময় ফুটবলে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সিলেট স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শককে আনন্দে ভাসায় ফাহিম মুর্শেদ। ডান দিক দিয়ে মোহাম্মদ শাওন তীব্র গতিতে ভারতের রক্ষণে দারুণ এক ক্রস ফেলেন। বক্সের ভেতর বাংলাদেশের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে ডামি খেলে দারুণ এক শটে ভারতের জালে বল ফেলেন ফাহিম।
১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ায় কিছুটা যেন আত্মতুষ্টি পেয়ে বসে বাংলাদেশ দলকে। বেশ কয়েকটি ভুলের খেসারত দিয়ে ভারতকে যেন খেলায় ফিরিয়ে আনে বাংলাদেশই। এমনই একটা সময়ে দূরপাল্লার এক চকিত শটে ভারতকে খেলায় ফিরিয়ে আনে অভিনাষ। তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার শঙ্কা আবারও পেয়ে বসে বাংলাদেশের ফুটবলকে।
পরের ২০ মিনিট ভারতীয় সীমান্তে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়ে গোলের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে অবশ্য খলিলের ক্রস থেকে মোহাম্মদ রনির দারুণ একটি হেড ভারতীয় গোলরক্ষক লুফে নিলে টাইব্রেকারে গড়ায় খেলায়।
টাইব্রেকারে দারুণ ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা।
ফাহিম মুর্শেদ, জাহাঙ্গীর আলম সজীব, আতিকুজ্জামান, সাদ উদ্দিন-প্রত্যেকের নেওয়া পেনাল্টি ছিল দারুণ দৃষ্টি নন্দন, বুদ্ধিদীপ্ত। ভারতের পক্ষে লক্ষ্যভেদ করেন সৌরভ আর মোহাম্মদ রকিব। অভিজিতের শটটি সাইড বারে লেগে ফেরত আসে। সাকলাইনের শটটি ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরিয়ে দিয়ে জয়ের নায়ক হন গোলরক্ষক ফয়সাল আহমেদ।
পুরো প্রতিযোগিতায় দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়েই সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি নিজের করে নিয়েছেন সারোয়ার জামান নিপু। ম্যাচ সেরা হয়েছেন মোহাম্মদ শাওন।
সাফ অনূর্ধ্ব ১৬ ফুটবলে এটাই বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা। টুর্নামেন্টে ভারতকে হারাল দ্বিতীয়বারের মতো। টুর্নামেন্টজুড়ে যুবাদের খেলায় ছিল আগামীর প্রতিশ্রুতি। এই সাফল্যকে প্রেরণায় রূপান্তরিত করে বাংলাদেশের ফুটবলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে কি বাফুফে?