খেলার বিটিভিতে বিটিভির 'খেলা'

মাঠে চলছে খেলা, বিটিভি ব্যস্ত ভিআইপি দর্শককে দেখানো ও তাঁর গুণকীর্তনে! বিটিভি থেকে নেওয়া ছবি
মাঠে চলছে খেলা, বিটিভি ব্যস্ত ভিআইপি দর্শককে দেখানো ও তাঁর গুণকীর্তনে! বিটিভি থেকে নেওয়া ছবি

পৃথিবীতে বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে...।’ সময়ের পরিক্রমায় চারদিকে কত বদল! বদলায়নি কেবল বিটিভি। আজ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ-ভারতের ফাইনালেও বিটিভি হাজির সেই পুরোনো রূপেই।
ম্যাচের বয়স তখন ৭৩ মিনিট। স্কোরলাইন ১-১। হঠাৎ টিভি পর্দায় ভেসে উঠল এক ব্যক্তির মুখ। কোনো এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ম্যাচের তখন উত্তেজনাকর মুহূর্ত। কী হয়, কী হয়। এমন সময় মাঠের খেলা বাদ দিয়ে দর্শকদের দেখতে হচ্ছে কোনো কর্মকর্তার চাঁদ বদন!
খেলা সরাসরি সম্প্রচার করতে গিয়ে বিটিভির ক্যামেরা বারবার ভিআইপি গ্যালারি ঘুরল। ফুটবল এমন একটা খেলা, মাঝখানের ১৫ মিনিটের বিরতি ছাড়া আর কোনো বিরতিই নেই। টানা চলে খেলা। এখানে ক্যামেরা এক মুহূর্তের জন্য সরানো মানেই ম্যাচে কী হচ্ছে তা জানার উপায় নেই। অথচ খেলার মাঝে মধ্যে ভিআইপি গ্যালারিতে চক্কর দেওয়ার কাজটা বিটিভি নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছে অনেক দিন ধরেই। বড় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের টুর্নামেন্ট হলে এই ঘটনার মাত্রাও যেন বেড়ে যায়। ক্রিকেটেও এটা মেনে নেওয়া যায় না। অন্যান্য দেশে ক্রিকেট সম্প্রচারের সময় ধারাভাষ্য কক্ষ দেখানো হয়। গ্যালারিতে সাবেক বা বর্তমান কোনো বড় তারা হলে তাদের দেখানো হ​য় কালেভদ্রে। কিন্তু বাংলাদেশে খেলা সম্প্রচার হলে ভিআইপি গ্যালারির অন্দরমহল দেখানো যেন বাধ্যতামূলক। এখানে অতিথিদের লিস্টিটাও যেহেতু লম্বা, এবং এক অতিথিকে দেখিয়ে আরেকজনকে না দেখানো মানে উটকো সমস্যার মুখে পড়ে যাওয়া; এ কারণে ভিআইপি গ্যালারির বায়ান্নবর্তী পরিবারের সবাইকেই দেখাতে হয়। দর্শকরা এতে বিরক্ত হচ্ছেন কি না, তাতে কারও কিছু যায় আসে না।

ক্রিকেটে তবু বিরক্তিটা কম হয়। এখানে প্রতি বলের মাঝখানে সময় পাওয়া যায়। সময় পাওয়া যায় প্রতি ওভারের বিরতিতেও। কিন্তু ফুটবলে সেই সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবল সম্প্রচারের সময় কোনো গোল হলে বা ম্যাচের কোনো উল্লেখযোগ্য মুহূর্তের জন্য চকিতে এক পলকের জন্য গ্যালারির দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। তারকা-টারকা কেউ থাকলে তারও সময় গোটা কয় সেকেন্ড বরাদ্দ। কিন্তু বিটিভি একবার ভিআইপি গ্যালারি দেখাতে শুরু করলে যেন ভুলেই যায়, মাঠে কী হচ্ছে।

খেলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়াল বিটিভি ও টুর্নামেন্ট কর্মকতার মুখ দেখানো!
খেলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়াল বিটিভি ও টুর্নামেন্ট কর্মকতার মুখ দেখানো!

সমস্যা হলো, এ সময় ধারাভাষ্যকাররাও মাঠের বদলে ক্যামেরায় ধরা মানুষটির গুণকীর্তনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গুণী মানুষের প্রশংসা করা ভদ্রজনোচিত কাজ। কিন্তু সেই প্রশংসা করার তো আরও অন্য অনেক সময় বা উপায় আছে। ফুটবল ম্যাচ সরাসরি চলার সময় কেন? কখনো কখনো এমন হয়, খেলা বাদ দিয়ে নেওয়া হয় কোনো কর্মকর্তার মিনি সাক্ষাৎ​কার!
সরাসরি সম্প্রচার করা খেলা দেখতে পেরে বিটিভির কাছে দর্শকেরা নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর বিনিময়ে দর্শকদের দিতে হয়েছে ধৈর্যের বিরাট পরীক্ষা। সেই সঙ্গে বিরক্তিকর ধারাভাষ্য তো আছেই।
ফুটবলের মতো দ্রুতলয়ের খেলায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ঘটে যেতে পারে মহাগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ কারণে অধিকাংশ সময়ে ক্যামেরার ফোকাস থাকে মাঠেই। বিটিভিকে তা বোঝাবে কে? খেলার শেষভাগ, একটা গোলই গড়ে দেবে ম্যাচের ভাগ্য, এমনই টানটান উত্তেজনার সময় বিটিভি কী করল? বাংলাদেশের আক্রমণভাগে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েছিল ভারতের এক খেলোয়াড়। টিভির সামনে দর্শকেরা নিশ্চয়ই উসখুস করেছিলেন চরম উৎকণ্ঠায়। কী হয়, কী হয়! হুট করে ক্যামেরা গেল ঘুরে। পর্দায় ভেসে উঠল স্থানীয় রাজনীতিক ও বাফুফের হর্তাকর্তাদের মুখ। এর মধ্যে কী হলো, কে জানে! ম্যাচজুড়েই দর্শকদের সইতে হয়েছে এমন নানা ‘অত্যাচার’!
এটা ঠিক, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিটিভির অবদান অনস্বীকার্য। বছরের পর বছর বাংলাদেশের আনাচে কানাচে দর্শকদের খেলা দেখার সুযোগ করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ টিভি চ্যানেলটি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পেশাদারির পরিচয় দিয়ে ব্যবস্থাপনা যখন আরও উন্নত হওয়ার কথা, বিটিভি তখন পড়ে রয়েছে মান্ধাতা আমলেই।
আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে বিটিভি কেন আঁকড়ে পড়ে আছে সনাতন যুগে? কেন তারা পারে না পুরোনো অভ্যাস বদলে আধুনিক হতে? দেশের ক্রিকেট, ফুটবলে যেখানে বদলের গান, বিটিভি কেন বদলাবে না?