রিকশাওয়ালা 'মেসি'!

গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি, রিকশার সামনে সেই রাতে বার্সেলোনার খেলার সূচি—মেসি বলতে অজ্ঞান শাহাবুদ্দিন—ছবি: শামসুল হক
গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি, রিকশার সামনে সেই রাতে বার্সেলোনার খেলার সূচি—মেসি বলতে অজ্ঞান শাহাবুদ্দিন—ছবি: শামসুল হক

গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি। পায়ে বুট। রিকশার হ্যান্ডেলে ঝোলানো জরাজীর্ণ ফুটবল। মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনকে দেখলে মনে হবে, কোথাও খেলতে যাচ্ছেন। কিন্তু মাঠ তাঁকে টানলেও সংসারের ঘানি টানতে বেরোতে হয় রাজপথেই!
পেশায় রিকশাওয়ালা শাহাবুদ্দিন থাকেন রাজধানীর মুগদাপাড়ায়। পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। সবাই তাকে ‘মেসি’ বলেই ডাকে। রিকশা চালানোর সময় গায়ে থাকে মেসির দশ নম্বর জার্সি। পল্টন, কমলাপুর, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম বা বায়তুল মোকাররমের গেট—যেখানেই যাত্রী নিয়ে যান না কেন, দোকানদাররা দেখলে বলে ওঠেন, ‘ওই যে মেসি যাচ্ছে!’
রিকশার সামনে-পেছনে উড়িয়েছেন আর্জেন্টিনার পতাকা। আছে লাল-সবুজ পতাকাও। রিকশার সামনে প্ল্যাকার্ডে লেখা লা লিগার সূচি। তবে সব ম্যাচের নয়, প্রিয় দল বার্সেলোনার খেলা যেদিন থাকে, সেদিনই ওই সময়সূচি লাগিয়ে ঘোরেন। যাত্রীদের কখনো খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানান। কখনো পুরনো খেলার ‘ধারাবর্ণনা’ শোনাতে শুরু করেন। নিরক্ষর শাহাবুদ্দিন যেন চলমান ‘ক্রীড়াসূচি’। কেউ জিজ্ঞাসা করলে অমনি কয়েক সপ্তাহের বার্সেলোনার ম্যাচের সময়সূচি গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করেন!
মেসি অন্তপ্রাণ শাহাবুদ্দিন। তবে মেসিকে নয়, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ম্যারাডোনার খেলা দেখেই ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেন, ‘ম্যারাডোনা যেবার বিশ্বকাপ জিতল, সেবার থেকেই তাঁর খেলা ভালো লাগত।’ ম্যারাডোনার পর মেসির খেলাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে। আর্জেন্টিনা বা বার্সেলোনা—যেখানেই মেসি, ম্যাচটি তাঁর দেখতেই হবে।
কখনো ফুটবল খেলেননি। কিন্তু ভীষণ ইচ্ছা ছিল ফুটবলার হওয়ার। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে কতদিন যে দেখেছেন ভেতরে ফুটবলের ‘রাস উৎসব’। কাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন নিজের কষ্টের কথাগুলো, ‘ছয় মাস বয়সে মাকে হারিয়েছি। বাবা মারা যান সাত বছরে। এরপর নানা-নানীর কাছে মানুষ হয়েছি। তারা গরীব ছিলেন। তাই স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি। শুধু স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম।’
শেরপুরের ৩৮ বছরের শাহাবুদ্দিন ঢাকায় এসেছেন প্রায় ২৫ বছর আগে। রিকশাটা চালান সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে। নিজের রিকশা নেই। মহাজনের রিকশা চালান আধাবেলা। এরপর ঘরে ফিরেই বসেন টিভির সামনে। ক্রিকেটও ভালো লাগে। তাই বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ওয়ানডে সিরিজের সূচিও প্ল্যাকার্ড বানিয়ে রিকশার সামনে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। টেলিভিশনে খেলা দেখার সুযোগ মেলেনি। রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছেন।
রিকশায় পতাকা-প্ল্যাকার্ড লাগানোর ভাবনাটার জন্ম বিশ্বকাপের সময়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার খেলা থাকলে সেদিন লোকে রিকশা চালাতেই দিত না, ‘মানুষ বিশ্বকাপের সময় আমাকে ঘিরে ধরত। তখন রিকশা চালাতে পারতাম না। মোবাইলে অনেকে ছবিও তুলত।’
চার বছর আগে ঢাকায় এসেছিল মেসির আর্জেন্টিনা। তবে নাইজেরিয়ার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচটা দেখা হয়নি বলে এখনও আফসোসে পোড়েন শাহাবুদ্দিন, ‘ভাগ্যটা খারাপ। হঠাৎ দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।’
আর্জেন্টিনার সমর্থেকরা সানন্দেই শাহাবুদ্দিনের রিকশায় চাপেন। কিন্তু সমস্যায় পড়েন ব্রাজিলের সমর্থকদের নিয়ে, ‘ব্রাজিলের সাপোর্টাররা ভুয়া বলে, গায়ে পানি ছেটায়।’ একবার দারুণ মজার ঘটনা ঘটেছিল দুই দেশের সমর্থককে নিয়ে, ‘দুই বন্ধু রিকশা ভাড়া করার পর একজন বললেন, উঠব না। উনি ছিলেন নেইমারের ভক্ত। আমি তাঁকে বললাম, মেসি আর নেইমারও তো বন্ধু। একই ক্লাবে খেলে। ওরা যদি একসঙ্গে থাকতে পারে, আপনারা পারবেন না কেন? আমার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে উনি উঠে বসলেন।’
গত বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার পরাজয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন। শাহাবুদ্দিনের দুনিয়ার পুরোটা জুড়েই খেলা। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘মেসি’। মজা করে বলছিলেন, ‘মানুষ আমাকে পাগল বলে। আমি ফুটবলের পাগল, মেসির পাগল।’
সে আর বলতে!