মিরপুরে কুমিল্লার রাত

জিতে গেছে দল। জয়ের নায়ক অলক কাপালিকে বরণ করে নিতে দৌড়ে মাঠে এলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের খেলোয়াড়েরা l শামসুল হক
জিতে গেছে দল। জয়ের নায়ক অলক কাপালিকে বরণ করে নিতে দৌড়ে মাঠে এলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের খেলোয়াড়েরা l শামসুল হক

এই সেই অলক, যাঁকে দলে নিতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে কোচ-অধিনায়ককে! এই সেই অলক, যাঁকে দিয়ে আর কিছু হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট পণ্ডিতদের অনেকেই! এই সেই অলক...অলক কাপালি?
‘ফর্ম ইজ টেমপরারি, ক্লাস ইজ পারমান্যান্ট’ কথাটাকে আরও একবার সত্যি প্রমাণ করে কাল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসকে বিজয় উল্লাসে মাতালেন অলক কাপালি। আতশবাজির আলোয় শুধু কুমিল্লা, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম স্লোগানে প্রকম্পিত, ‘কুমিল্লা...কুমিল্লা’। কিন্তু সেই আলো, সেই স্লোগান কি অলককে স্পর্শ করল?
সংবাদ সম্মেলনে আসার পথটায় তিনি পড়ে গেলেন আড়ালে। ফ্র্যাঞ্চাইজির চেয়ারম্যান নাফিসা কামাল ট্রফি হাতে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন সংবাদ সম্মেলনকক্ষের দিকে। তাঁকে ঘিরে সেলফি শিকারিদের একটা দল। আরেকটা দল ‘মাশরাফি ভাই...মাশরাফি ভাই’ বলে কুমিল্লার অধিনায়ককে রীতিমতো টানাহেঁচড়ার মধ্যেই ফেলে দিলেন ছবি তোলার জন্য। অলক সেসব দেখতে দেখতে মাঠের একপাশ ধরে এগোচ্ছেন। তখনই জানতে চাওয়া হলো—
* এখন কি বিশ্বাস হচ্ছে ম্যাচটা জিতেছেন?
—কেন হবে না! যখন দেখলাম সামি বোলিংয়ে এসেছে, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমরা জিতব। কারণ, ওর বলে মারা সম্ভব।
সাংবাদিকদের অনেকে মাশরাফিকেই আগে প্রশ্ন করতে চাইলেন। কিন্তু জয়ের নায়ককে পাশে রেখে বিজয়স্তম্ভে কী করে আগে ওঠেন তিনি! ‘অলক ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ওকেই আগে প্রশ্ন করুন’ বলে মাশরাফি আরও একবার বোঝালেন, কেন তিনি অধিনায়কদেরও অধিনায়ক।
মোহাম্মদ সামির শেষ ওভারে জেতার গল্পটা শুনুন অলক কাপালির মুখে—
‘৮ বলে যখন ২১ রান দরকার ছিল, তখনো মনে হচ্ছিল শেষ ওভার পর্যন্ত থাকলে জয় সম্ভব। এই উইকেটে শেষ ওভারে ১৭-১৮ রানও হতে পারত। শেষ বলে কুলাসেকারাকে বলছিলাম, এক রান নিব। ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলব না। তাহলে ম্যাচ সুপার ওভারে চলে যেতে পারে।’
মাঠে অলক-কুলাসেকারা মিলে যখন জয়ের চিত্রনাট্য লিখছেন, মাশরাফি তখন ড্রেসিংরুমে শুয়ে। আগের ওভারেও ভিউয়িং এরিয়ায় পায়চারি করতে দেখা গেছে অধিনায়ককে। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে হলো শেষ ওভারটা ড্রেসিংরুমের ভেতরে থাকলেই দল জিতবে, ‘শেষ ওভারে আমি গিয়ে ফিজিওর বেডে শুয়ে ছিলাম। ওটাই আমার সবচেয়ে আপন জায়গা। মনে হচ্ছিল আমি ড্রেসিংরুমের ভেতরে থাকলে ম্যাচ জিতব।’
মাশরাফিই ঠিক। হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতা অধিনায়ক হিসেবে উঁচিয়ে ধরেছেন তৃতীয় বিপিএলের সোনালি ট্রফি। বরিশাল বুলস অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর জন্য সেই ছবি যেন ট্র্যাজেডির স্মারক! ব্যাট হাতে ৪৮ রান, বল হাতে ২ উইকেট, ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ ও একটা রানআউটে অবদান—পুরো টুর্নামেন্টেই ভালো খেলার পর ফাইনালেও অধিনায়কের মতোই সামনে থাকলেন। তারপরও শিরোপার কাছ থেকে ফিরে আসাটাকে দুর্ভাগ্য মানছেন। তবে হতাশ নন মাহমুদউল্লাহ। দল এবং নিজের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট তিনি। তারপরও একটা অতৃপ্তি, ‘গত বিপিএলের ফাইনালেও হেরেছিলাম। এবার চেয়েছিলাম মাশরাফি ভাই হ্যাটট্রিক করতে না পারুক। কিন্তু হলো না।’
হলো না ‘প্লেয়ারস বাই চয়েসে’ কোনো দলেরই পছন্দের তালিকায় না থাকা অলকের জন্য। কিন্তু যাঁকে তখন কেউই নিলেন না, কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন আর মাশরাফি কেন পরে সেই অলককে দলে নিতেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন? তাঁদের কেন মনে হয়েছিল, অলককে দিয়ে হবে? মাশরাফির উত্তর, ‘অভিজ্ঞতার কারণে। টি-টোয়েন্টিতে তরুণদের চেয়ে অভিজ্ঞরাই বেশি সফল। তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে পারে...অলক যেটা আজ (গতকাল) করল।’
অলকের ওই অভিজ্ঞতাই গ্যালারিতে থাকা কুমিল্লার হাজার হাজার দর্শকের মধ্যে বইয়ে দিল আনন্দের বন্যা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের প্রধান উপদেষ্টা আ হ ম মুস্তফা কামালও ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলেন তিনি দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী। ল্যাপ অব অনারের সময় খেলোয়াড়দের পেছন পেছন দ্রুত পায়ে ছুটলেন সদলবলে। দূর থেকেও অনুমান করা যাচ্ছিল দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া মাশরাফির দলের কাছে তাঁর আর্তিটা—আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নাও। আমিও তো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস!

বিপিএলের তৃতীয় আসরের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস l প্রথম আলো
বিপিএলের তৃতীয় আসরের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস l প্রথম আলো

রোল অব অনার
২০১১-১২
চ্যাম্পিয়ন: ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস রানার্সআপ: বরিশাল বার্নার্স
২০১২-১৩
চ্যাম্পিয়ন: ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস রানার্সআপ: চিটাগং কিংস
২০১৫-১৬
চ্যাম্পিয়ন: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস রানার্সআপ: বরিশাল বুলস