আসলেই ভিক্টোরিয়ানস!

মাশরাফির জয়োল্লাস, কুমিল্লার জয়োল্লাস! রোমাঞ্চকর ফাইনালে বরিশাল বুলসকে ৩ উইকেটে হারিয়ে বিপিএলের তৃতীয় আসরের শিরোপা জিতল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। অধিনায়ক হিসেবে বিপিএলে শিরোপা জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’ হলো মাশরাফির। কাল মিরপুরে l শামসুল হক
মাশরাফির জয়োল্লাস, কুমিল্লার জয়োল্লাস! রোমাঞ্চকর ফাইনালে বরিশাল বুলসকে ৩ উইকেটে হারিয়ে বিপিএলের তৃতীয় আসরের শিরোপা জিতল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। অধিনায়ক হিসেবে বিপিএলে শিরোপা জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’ হলো মাশরাফির। কাল মিরপুরে l শামসুল হক

যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন, আস্কিং রেট ১২.৫৮। ১১ বলে চাই ২৩ রান। পারবে কুমিল্লা?
প্রশ্ন এটাই ছিল বটে, তবে একটু ঘুরিয়ে আসলে যা হয়ে গেল—পারবেন মাশরাফি?
মাশরাফি নামের অত্যাশ্চর্য এক গল্পকে আরও রংচঙে করে তুলেছে এই বিপিএল। পরশপাথর হয়ে বদলে দিয়েছেন সাধারণ এক দলকে। সেই গল্পের শেষ অধ্যায়টাও কি তাঁর বীররসেই রঞ্জিত হতে যাচ্ছে!
হলো না! প্রথম বলেই চালালেন মাশরাফি। এক্সট্রা কাভারে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেওয়ার পর সতীর্থদের উল্লাসের মধ্যমণি হয়েও মাহমুদউল্লাহ আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত। উল্লাস যা করার, তা যেন জিতেই করবেন। এই ফাইনাল তো ‘মাহমুদউল্লাহর ম্যাচ’-ই হতে যাচ্ছে!
কে জানত, এই ফাইনাল এমন রোমাঞ্চ জমিয়ে রেখেছে! রুদ্ধশ্বাস মিনিট ১০-১২ পর যে রোমাঞ্চকর নাটকের শেষ অঙ্কে মাহমুদউল্লাহ হতাশায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। ডাগআউটে তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
টি-টোয়েন্টির সঙ্গে ‘ক্লাসিক’ শব্দটি ঠিক যায় না। বৃহত্তর অর্থে হয়তো যায় না, তবে টি-টোয়েন্টি তার মতো করে ক্লাসিক তো হতেই পারে। বিপিএলের তৃতীয় ফাইনাল হয়ে থাকল সেই ক্লাসিক টি-টোয়েন্টির এক বিজ্ঞাপন।
পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচ কখনো কুমিল্লার দিকে হেলে পড়ে তো কখনো বরিশালের দিকে। এই উত্থান-পতন আর নাটকীয়তা শেষে এসে প্রতীকী রূপ নিল। শেষ বলের আগে কোনো দলই আর এগিয়ে নেই। স্কোরে সমতা। আরও কি কিছু বাকি আছে তাহলে! সুপার ওভারেই শেষ হবে এই অনিশ্চয়তার?
অলক কাপালি তা হতে দিলেন না। অমিত প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবির্ভাব তাঁর। সেই প্রতিশ্রুতির সামান্যই পূরণ হয়ে উল্টো অলক হয়ে আছেন এক আক্ষেপের নাম। হারিয়ে যাওয়া সেই অলকই সবাইকে ছাপিয়ে নায়ক হয়ে গেলেন শেষে। ২৮ বলে ৩৯ রান, জয়সূচক রানটিও তাঁর ব্যাট থেকেই। শেষ দুই ওভারে ২৩ রান দরকার ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের, এর ২১ রানই অলকের ব্যাট থেকে।
মাহমুদউল্লাহকে ‘ট্র্যাজিক হিরো’ বানিয়ে দেওয়ার মূলেও তিনিই। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা ঠিক যায় না। তাঁর আমুদে চরিত্রের সঙ্গে শুধু ঘনিষ্ঠ মহলেরই পরিচয়। বাইরের পৃথিবীতে মাহমুদউল্লাহ লাজুক-অন্তর্মুখী এক তরুণ, ব্যাটিং-বোলিংয়েও যে ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট প্রতিফলন। টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা চরিত্র থেকে যা শত হস্ত দূরে।
সেই মাহমুদউল্লাহই বুঝিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টি শুধু একভাবেই খেলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এটি তাঁর মতো করেও খেলা যায়। ৩৬ বলে ৪৮ রানের ইনিংসটিতে খুদে ক্রিকেটের দাবি মেটানো স্কুপ যেমন থাকল, তেমনি আবু হায়দারের বলে চোখ জুড়ানো এক্সট্রা কাভার ড্রাইভও। যেটি ধ্রুপদি ক্রিকেটেও ধ্রুপদি শটের মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার।
শুধু ব্যাটিংয়েই তো শেষ নয়, আল আমিন প্রথম ওভারেই মার খাওয়ার পর বল হাতে নিয়ে ম্যাচ বের করে নিতে থাকা ইমরুল ও শেহজাদ দুজনকেই ফেরালেন। ৪ ওভারে ২৩ রান দিয়ে ২ উইকেট। ব্যাটিং হলো, বোলিং হলো। ফিল্ডিংও বাদ থাকল না। টুর্নামেন্টে কুমিল্লার তুরুপের তাস আসহার জাইদিকে রান আউট করলেন। এরপর মাশরাফিকে ফেরানো ওই ক্যাচ। মাহমুদউল্লাহর এর চেয়ে বেশি কিছু করার ছিল না।
ম্যাচটা রিওয়াইন্ড করে দেখলে নায়ক হতে পারতেন, এমন অনেকেরই দেখা মিলবে। শাহরিয়ার নাফীস, মাহমুদউল্লাহ, ইমরুল কায়েস, আহমেদ শেহজাদ...ম্যাচ-পূর্ব আলোচনাতে অবশ্য এঁদের সবারই নাম ছিল। ছিল না শুধু অলক কাপালির।
তা ক্রিকেট তো এমন বিস্ময় উপহার দিতে ওস্তাদই। ফাইনালের আগে সবচেয়ে আলোচিত লড়াইটার কথাই ধরুন না! যুদ্ধের মধ্যে খণ্ড খণ্ড লড়াই থাকে। অনেকের চোখেই ফাইনালে সেই লড়াইয়ের নাম ছিল ‘আবু হায়দার বনাম সাব্বির রহমান’। কিন্তু ক্রিকেট যে কখনো কখনো ছলনা করতে বড় ভালোবাসে! ম্যাচে সবচেয়ে খরুচে ওভারটি (১৯তম ওভারে ১৮ রান) তাই হায়দারের হাত থেকেই বেরোল। ৪ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে কোনো উইকেট নেই। আর আগের ম্যাচে ‘গেইল’ হয়ে যাওয়া সাব্বির ৯ রান করলেন, সেটিও ১৯ বলে!
ক্রিকেট বিধাতা শেষটা তাঁর মতো করেই ভেবেছেন। নামের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ানস। ‘ভিক্টোরি’ তাই কুমিল্লারই প্রাপ্য। কাকতালীয়ভাবে, সেটিও এল কি না এমন এক রাতে, যখন মাত্র ঘণ্টা দেড়েক পরই এ দেশের ইতিহাসে স্মরণীয়তম ‘ভিক্টোরি’র প্রথম প্রহর। রাত ১১টার দিকে শুরু হওয়া আতশবাজি যেন মিলেমিশে গেল সেই বিজয় দিবসেরই উদ্যাপনের সঙ্গে!

বরিশাল: ২০ ওভারে ১৫৬/৪
কুমিল্লা: ২০ ওভারে ওভারে ১৫৭/৭
ফল: কুমিল্লা ৩ উইকেটে জয়ী