পুলের সঙ্গী থেকে জীবনের সঙ্গী

>খেলার মাঠে পরিচয়। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গভীর হয়েছে। কবে কখন একজন হয়ে গেছেন আরেকজনের পরিপূরক, বুঝতেই পারেননি। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন জুটি রয়েছেন বেশ কজন। সেই দম্পতিদের ঘরের খবর উঠে এসেছে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ থাকছে এসএ গেমসে সোনাজয়ী সাঁতারু দম্পতি শাহজাহান আলী রনি ও মাহফুজা খাতুন শিলার গল্প। জানাচ্ছেন বদিউজ্জামান
২০১০ সালে আগ্রার তাজমহলের সামনে সাঁতারের জুটি শাহজাহান রনি ও মাহফুজা শিলা। ছবি: সংগৃহীত।
২০১০ সালে আগ্রার তাজমহলের সামনে সাঁতারের জুটি শাহজাহান রনি ও মাহফুজা শিলা। ছবি: সংগৃহীত।

ঘটনাটা ২০১০ সালের। বাংলাদেশ দলের সঙ্গী হয়ে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে গিয়েছিলেন সাঁতারু শাহজাহান আলী রনি ও মাহফুজা খাতুন শিলা। আগ্রায় সম্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমের স্মৃতিসৌধ তাজমহলের সামনে সাঁতারু শাহজাহান হয়ে গেলেন প্রেমিক পুরুষ। সেদিনই মাহফুজার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো দিনও তাঁকে ছেড়ে না যাওয়ার।

বাংলাদেশের হয়ে দুজনই পুল মাতিয়েছেন এসএ গেমস। দুজনেরই প্রিয় ইভেন্ট ব্রেস্ট স্ট্রোক। ২০০৬ শ্রীলঙ্কা এসএ গেমসে ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সোনা জিতেছিলেন শাহজাহান। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের গুয়াহাটি ও শিলংয়ে শেষ হওয়া এসএ গেমসে ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে জোড়া সোনা জিতেছেন মাহফুজা। ক্রীড়াঙ্গনের এই জুটি এবার জীবনেরও জুটি গড়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুবক শাহজাহান ১৮ মার্চ বিয়ে করেন যশোরের জলকন্যা মাহফুজাকে।

ভালোবাসার প্রস্তাবটা কে আগে দিয়েছিল? প্রশ্নটা করতেই মাহফুজার লাজুক উত্তর, ‘ও কথা আমার একদমই মনে নেই।’ শুধু এটুকু মনে আছে মাহফুজার, ‘ও ছিল তখন বিকেএসপির সেরা খেলোয়াড়। চারদিকে ওর অনেক নাম-যশ। আমিও যেহেতু ওর মতোই ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্টে সাঁতরাই, তাই কোচ স্যার ওর কাছ থেকে টিপস নিতে বলেছিলেন।’ বিকেএসপিতে এভাবেই দুজনের পরিচয়। এরপর ধীরে ধীরে ভালো লাগা থেকে হয়ে গেল ভালোবাসা।

সেই ২০০২ সালে দুজনের পরিচয়। চৌদ্দ বছরের সম্পর্ক। কিন্তু সবে মাত্র সংসার শুরু করেছেন দুজন। ঘরকন্নার চেয়ে ইদানীং বিয়ে-পরবর্তী সামাজিকতা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই সময় কেটে যাচ্ছে মাহফুজার, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে যশোর, যশোর থেকে ঢাকা, এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে। ঘরকন্নার প্রস্তুতি নেওয়ারই সময় পাচ্ছি না।’


যদিও সংসার সামলানোর ব্যাপারটা এখনই ভাবছেন না দুজনের কেউই। শাহজাহান বলছিলেন, ‘ আমাদের সব মনোযোগ আপাতত আগামী এসএ গেমসের ক্যাম্প নিয়ে।’ ১ এপ্রিল কোরিয়ান কোচ পার্ক তে গুণের অধীনে আবারও দীর্ঘ মেয়াদি অনুশীলন শুরু করবেন শাহজাহান-মাহফুজা।

স্বামীকে নিয়ে মাহফুজার চমৎকার মূল্যায়ন, ‘ও জীবন-সঙ্গী হিসেবে মোটেও মন্দ না। খুবই দায়িত্ববান। তবে একটু সহজ সরল। কোনো প্যাঁচঘোঁচ নেই। পান-সিগারেট খায় না। কোনো বাজে অভ্যাসও নেই।’

জোড়া সোনা জিতে দেশে ফেরার পরই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন মাহফুজা। অবশ্য শাহজাহানের পরিবার থেকেই প্রথমে বিয়ের প্রস্তাবটা আসে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন মাহফুজা। নৌবাহিনীর চুক্তিভিত্তিক চাকরিটা কবে স্থায়ী হবে সেই আশায় দিন গুনছেন। মাহফুজার বছরটা শুরু হয়েছে সোনায় মুড়িয়ে, ‘আসলেই বছরটা খুব ভালো যাচ্ছে।’

ক্যারিয়ারে দুজনার পারফরম্যান্সের উত্থান-পতন দেখা গেছে নানা সময়। অনেকবার ফেডারেশনের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন মাহফুজা। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন শাহজাহান। কিন্তু দুঃসময়ে একে অপরের পাশেই থেকেছেন দুজনে। মাহফুজা সেই স্মৃতি হাতড়িয়ে বললেন, ‘২০০৯ সালে ও ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে সুযোগ পায়নি। আমি সেবার একাই ভারতে গিয়েছিলাম। এসে ওকে বলেছিলাম দেখো, তুমি আবারও জাতীয় দলে ফিরবে। ঠিকই ফিরেছিল রনি।’ কখনো-কখনো দুজনের মধ্যে মান-অভিমানও হয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণটাও জানালেন মাহফুজা, ‘আসলে আমাদের বোঝাপড়াটা খুব ভালো।’

একই সুরে কথা বললেন শাহজাহানও, ‘শিলার সবচেয়ে বড় গুণ, ও খুব যত্নশীল। কখন কি করতে হবে, কোনটা বলা উচিত, কোনটা উচিত না ও এসব বেশি ভাবে। আসলে পরস্পরকে সহজেই বুঝতে পারি আমরা।’

দুজনের ভালোবাসার রসায়নটা যেন সুইমিং পুলের নীল জলের ঢেউয়ের মতোই। অভিমানের বুদ্বুদ উঠলেও মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না।