বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন যিনি

>

একসময়ের টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিকে বোলিং কোচ হিসেবে পেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কিন্তু অসাধারণ সব কোচকে পেয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অবদান আছে যাঁদের, সেই কোচদের নিয়ে আমাদের নতুন ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে থাকছেন গর্ডন গ্রিনিজ

আকরাম, আমিনুল, মেহরাবদের গুরু ছিলেন যখন। ফাইল ছবি
আকরাম, আমিনুল, মেহরাবদের গুরু ছিলেন যখন। ফাইল ছবি

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলাটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরাধ্য এক স্বপ্ন। ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি সেই স্বপ্ন পূরণের বিরাট সুযোগ হয়ে এলেও ব্যর্থতাই সঙ্গী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফির আসর তাই ছিল অগ্নিপরীক্ষা। আর সেই কঠিন পরীক্ষায় উতরে দিতেই বাংলাদেশে এসেছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, ক্রিকেটেরই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। ডেসমন্ড হেইন্সের সঙ্গে যাঁর উদ্বোধনী জুটির কীর্তিগাথা আজও রূপকথা হয়ে আছে।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ার এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এসিসি ট্রফির সাফল্যের পরপরই বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (পরে ‘কন্ট্রোল’ বাদ দেওয়া হয়েছে) আটঘাট বেঁধে নামে জাতীয় দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে লক্ষ্যে অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল ক্যারিবীয় গ্রেট গ্রিনিজকে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। গ্রিনিজের জন্যও সেটি ছিল কোনো জাতীয় দলের হয়ে প্রথম দায়িত্ব নেওয়া।

গ্রিনিজের বাংলাদেশে আসাটা তৈরি করেছিল দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সৃষ্টি করেছিল অপার আনন্দ ও গৌরবের; বিশেষ করে গ্রিনিজের ব্যাটিং দেখার সুখস্মৃতি তখনকার প্রজন্মের অনেকের মনেই তো টাটকা। সেই গ্রিনিজের মাপের একজন কিনা আসছেন এই বাংলাদেশে, যে বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখনো কেনিয়া-হল্যান্ডদের কাতারে।

আইসিসি ট্রফিকে সামনে রেখে গ্রিনিজের অধীনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আবাসিক ক্যাম্প হয়েছিল বিকেএসপিতে। চার-পাঁচ মাসের নিবিড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শেষে বিশ্বকাপে জায়গা করে মিশন নিয়ে আইসিসি ট্রফিতে খেলতে মালয়েশিয়া–যাত্রা। অধিনায়ক আকরাম খান। এ দেশের ক্রিকেটের মানচিত্রই চিরদিনের জন্য বদলে দেওয়া সেই ’৯৭–এর আইসিসি ট্রফি!

আইসিসি ট্রফির পুরোটা সময় গ্রিনিজ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার অফুরন্ত ভান্ডার। সেমিফাইনালে ওঠার পথে সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ ছিল হল্যান্ডের বিপক্ষে, পেন্ডুলামের মতো দুলছিল সে ম্যাচের গতি-প্রকৃতি। হল্যান্ডের মামুলি সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে ১৫ রানে প্রথম ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। পরে বৃষ্টির আসা-যাওয়ার খেলা, ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে গেলে নিজেদের সর্বনাশ হওয়ার শঙ্কা—সব মিলিয়ে ভয়ংকর স্নায়ুক্ষয়ী এক ম্যাচ ছিল সেটি। হারলে যে বিশ্বকাপ স্বপ্নও ধুয়ে যাবে!

আকরাম খানের অনবদ্য ৬৭ রানের সুবাদে হল্যান্ড বাধা পেরিয়ে সেমিফাইনালে উঠেই বিশ্বকাপ–স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক দূর এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। সেমিতে স্কটল্যান্ডকে সহজেই হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঠাঁই করে নেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অভিজাত জগতে। স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে আরও এক ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। আরও একটি বৃষ্টিবিঘ্নিত স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে কেনিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ ঘরে তোলে আইসিসি ট্রফির স্বপ্নের শিরোপা। সেই জয়ও আসে শেষ বলে!

একের পর এক স্নায়ুক্ষরার এই মুহূর্তগুলো বাংলাদেশ পার করতে পেরেছিল গ্রিনিজের অভিজ্ঞতার কারণেই। বাংলাদেশ দলের সাজঘরে সে সময় তাঁর মতো একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি বদলে দিয়েছিল ছবিটা। চাপের মুহূর্তে মাঠের বাইরে থেকে তিনি যেভাবে দলের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতেন, তা আজও স্মৃতিতে অম্লান অনেকের। গ্রিনিজ নিজেও যেন তখন হয়েছিলেন বাংলাদেশেরই একজন।

আইসিসি ট্রফি জয়ের পর পুরো দলের সঙ্গে তাঁকেও সরকারিভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর পর বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়া দ্বিতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

গ্রিনিজের অধীনে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের আগে বেশ কয়েকটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তাঁর অধীনেই কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে জয়। গ্রিনিজের অধীনে সাফল্য-ব্যর্থতা হাতে হাত মিলিয়েই এগিয়েছে। তাঁকে নিয়ে আছে কিছু সমালোচনাও। তবে তাঁর সময়ের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখার সুযোগ খুব কমই। গ্রিনিজের সময়েই ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ, মেহরাব হোসেনের ব্যাটে।

অচেনা ও কঠিন ইংলিশ কন্ডিশনে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ স্থানীয় কাউন্টি দলগুলোর বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ খেলে। এসেক্স আর আর মিডলসেক্সের বিপক্ষে দুটি জয় বাংলাদেশকে নিশ্চয়ই বাড়তি আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে স্নায়ুক্ষরা এক ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। তবে এরই মধ্যে ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটি ছিল নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক জয়ের সেই ম্যাচটির কয়েক ঘণ্টা আগে গ্রিনিজের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বিদায়ের চিঠি।

সে সময় ক্রিকেট প্রশাসকদের সঙ্গে কিছু ব্যাপারে গ্রিনিজের টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশ তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে ব্যাকুল। অথচ বাংলাদেশ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরুই করেছিল ১৯৯৯ সালে। গ্রিনিজের মত ছিল, টেস্ট খেলার জন্য বাংলাদেশ এখনো ​তৈরি নয়। দলের কোচেরই এমন মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি ক্রিকেট কর্তারা। ভেতরে-ভেতরে এত নাটকের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নেমে আরও নাটকীয়তা। সেই ম্যাচটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যায় আরেক ধাপে। চাকরি হারানো গ্রিনিজ তবু সেদিন এসেছিলেন মাঠে, দেখা করে গিয়েছিলেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে।

বিদায়টা খুব সুখের না হলেও গ্রিনিজের মনে যে বাংলাদেশের একটা আলাদা জায়গা আছে, তার প্রমাণ মেলে ২০০০ সালে,বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের ক্ষণে। সেবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে কাটানো তাঁর ২০ মাস গ্রিনিজ কখনোই ভুলবেন না। নিজের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্বটা ছিল কোচ হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় দায়িত্ব। আমার সময়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল, যা তাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আমার অনেক স্মৃতি। আমরা সবাই মিলে যা যা অর্জন করেছিলাম, তার জন্য আমি এখনো গর্ববোধ করি।’

শুধু ক্রিকেট নয়, এ দেশের মানুষের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটাও ভুলবেন না গ্রিনিজ। সেই সবুজ পাসপোর্ট হয়তো আজ আর নেই। কিন্তু লাল-সবুজ পতাকার সঙ্গে আবেগটা আছেই, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আমার হৃদয়ের উষ্ণতম জায়গাজুড়েই আছে।’