আইসিসি এখন শুধুই একটা ‘ইভেন্ট অর্গানাইজিং কোম্পানি’

নিরাপত্তা শঙ্কায় পাকিস্তান সফর বাতিল করে চলে গেছে নিউজিল্যান্ডছবি: এএফপি

নিউজিল্যান্ড পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা যে দিয়েছে, তারও এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এর তিন দিন পর ইংল্যান্ড জানিয়ে দেয়, তারাও আগামী মাসে পাকিস্তান সফরে যাবে না। কিন্তু এই দুই সিদ্ধান্তের রেশ এখনো কাটেনি। সহজে কাটবে বলেও মনে হচ্ছে না।

কাটবে কীভাবে? এই দুই সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত যে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন আবার সংশয়ে ফেলে দিয়েছে! পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটাররা প্রতিদিনই এ নিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের কথায় পাকিস্তান কতটা নিরাপদ, পাকিস্তানের সঙ্গে কীভাবে অন্যায় আচরণ করছে নিউজিল্যান্ড—ইংল্যান্ডের মতো দলগুলোর সে ভাব ফুটে উঠছে। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সাবেকরাও কথা বলছেন এ নিয়ে। তাঁদের কেউ অবশ্য পাকিস্তানের জন্য সহমর্মিতা জানাচ্ছেন, কেউবা সমর্থন জানাচ্ছেন নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্তের।

তবে ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল আথারটন হাঁটছেন উল্টো পথে। ইংলিশ দৈনিক দ্য টাইমসে লেখা কলামে এক দিন আগেই লিখেছিলেন, পাকিস্তানের প্রতি ইংল্যান্ড বোর্ডের দেনা আছে। গতকাল নিজের কলামে আবার আথারটন ধুয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিকে।

তাঁর চোখে ইংল্যান্ডের বোর্ড খেলোয়াড়দের দাপটের কাছে মাথা নত করছে। আর আইসিসি? আথারটনের কাছে সেটি এখন শুধুই একটা ‘ইভেন্ট অর্গানাইজিং কোম্পানি’।

মাইকেল আথারটন
ছবি: সংগৃহীত

আফগানিস্তানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা ইতিউতি শোনা গিয়েছিল আগে থেকেই। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড দল তাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে, এই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোনো ম্যাচ না খেলেই পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয় গত শুক্রবার।

এরপর গত মঙ্গলবার ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) জানিয়ে দেয়, আগামী মাসে তাদের ছেলেদের ও মেয়েদের—দুই দলেরই পাকিস্তান সফরে যাওয়ার কথা থাকলেও ‘খেলোয়াড় ও দলের সহকারীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা’ এবং এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সফর ‘আইসিসির টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য আদর্শ নয়’ বলে তারা পাকিস্তান সফরে যাবে না।

সিদ্ধান্তটা মোটেও পছন্দ হয়নি আথারটনের। ইংল্যান্ডকে ৫৪টি টেস্ট ও ৪৩টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়া আথারটন দ্য টাইমসে লিখেছেন, ‘এই সপ্তাহে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার প্রদর্শনে ইসিবি নিজেদের কতটা দুর্বল প্রমাণিত করেছে, তা পরিমাপ করা যাবে না। যে মুহূর্তে খেলোয়াড়েরা আরও বেশি ক্ষমতাবান হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আরও বেশি দুর্বল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’

খেলাটার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভারসাম্য আনার ক্ষমতা যাদের সবচেয়ে বেশি, সেই আইসিসিই এখন একটা অনুষ্ঠান আয়োজক সংস্থায় (ইভেন্ট অর্গানাইজিং কোম্পানি) পরিণত হয়েছে।
সময়ের ক্রিকেটে আইসিসির ভূমিকা নিয়ে মাইকেল আথারটন

নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রসঙ্গ যখন এল, বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও ধুয়ে দিয়েছেন আথারটন, ‘খেলাটার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভারসাম্য আনার ক্ষমতা যাদের সবচেয়ে বেশি, সেই আইসিসিই এখন একটা অনুষ্ঠান আয়োজক সংস্থায় (ইভেন্ট অর্গানাইজিং কোম্পানি) পরিণত হয়েছে। নিজেদের টুর্নামেন্টগুলো ওরা ঠিকঠাকভাবেই আয়োজন করে—বিশ্বকাপ, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এমন সব টুর্নামেন্ট। কিন্তু খেলাটার নৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা খেলাটা কোন দিকে যাচ্ছে, সেটি ঠিক করায় প্রভাবের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান নড়বড়ে।’

পাকিস্তান সফর বাতিল করে ইসিবি নিজেদেরই ক্ষতি করেছে বলেও রায় দিয়েছেন আথারটন, ‘ওদের (ইসিবি) পারফরম্যান্স ইংলিশ ক্রিকেটকে নিয়ে একটা ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিল। নিজেদের এরই মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু সুনামের বড় ক্ষতিই করেছে ওরা। আইসিসির পূর্ণ সদস্য একটা দেশ—পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট করেছে, সর্বশেষ ছয় গ্রীষ্মের মধ্যে পাঁচটিতেই আমাদের অতিথি হিসেবে যে পাকিস্তানের আচরণ প্রশংসিত ছিল।’

ইংল্যান্ডের সিদ্ধান্তে পাকিস্তান কতটা কষ্ট পেয়েছে, সেদিকেও নজর ফিরিয়েছেন আথারটন। তাঁর চোখে, পাকিস্তানের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক সব সময়ই ভালো ছিল, এমন দাবি করা না গেলেও সম্প্রতি দুই বোর্ডের সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। সে কারণে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো দলের চেয়েও ইংল্যান্ডের পাকিস্তান সফর বাতিল করায় পিসিবি বেশি কষ্ট পাবে বলে দাবি আথারটনের।

নিউজিল্যান্ডের পর ইংল্যান্ডও ‘স্বাগতিক’ হিসেবে পাকিস্তানের দক্ষতায় কালিমা লেপে দেওয়ার পর পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক রমিজ রাজা তাদের কড়া সমালোচনা করেছেন। সে সমালোচনার ভাষায়ও রমিজ প্রাচ্য-পশ্চিমের চিরকালীন বিভাজনের দেয়ালটা দৃশ্যমান করে দিয়েছেন।

পিসিবির নতুন চেয়ারম্যান রমিজ রাজা ক্ষুব্ধ হয়েছেন নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের ওপর
ছবি: এএফপি

আথারটন সে প্রসঙ্গ টেনে এনে লিখেছেন, ‘অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখে সেটি বোঝার জন্য মঙ্গলবার রমিজের কথাগুলো শুনলে চমকে যেতে হয় (বলেই ফেলি, অন্যরা আমাদের ভালোভাবে দেখে না)। ক্রিকেটে বিভাজনের অবস্থা এবং উপমহাদেশের বাস্তবতা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের অপারগতা বোঝাতে বেশ কয়েকবার তিনি ‘পশ্চিমা দেশগুলো’ ‘পশ্চিমা মানসিকতা’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। অন্তত এই বিষয়ে তিনি ঠিকই বলেছেন।’

খেলোয়াড়দের দাপটের সামনে ইংলিশ বোর্ড নতজানু হয়ে থাকে বোঝাতেও বেশ কড়া ভাষায় লিখেছেন আথারটন। তাঁর চোখে, ‘দুটি কারণে আগের চেয়ে খেলোয়াড়েরা এখন অনেক বেশি ক্ষমতাবান। প্রথমত, অর্থ এবং অর্থের যেভাবে বণ্টন হয় সেটি। দ্বিতীয়ত, খেলোয়াড়দের হাতে এখন অনেক সুযোগ। খেলোয়াড়দের ক্ষমতার প্রভাব ড্রেসিংরুমেও স্পষ্ট। একসময়ের সাহসী জাতীয় নির্বাচক এড স্মিথের কিছু মতামত—সিদ্ধান্ত দু-একজন সিনিয়র খেলোয়াড় ভালোভাবে নেয়নি। সেটির ফল, এখন আর কোনো জাতীয় নির্বাচক নেই।’

গত গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড যে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে না খেলে ফিরে এসেছিল, সেটির পেছনেও খেলোয়াড়দের ক্ষমতার দাপটই কাজ করেছে বলে লিখেছেন আথারটন। নিজের মতের সমর্থনে ইংলিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের প্রসঙ্গও তুলে এনে কলামের শেষ টেনেছেন সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক, ‘দ্য গার্ডিয়ানে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে আলোচনার সময়ে (ইসিবির) প্রধান নির্বাহী টম হ্যারিসন—যাঁর কিনা ইসিবির অন্য অনেকের চেয়েও খেলাটার জন্য দরদ বেশি, তিনি (ইসিবির) ক্রিকেট পরিচালক অ্যাশলি জাইলসকে মেইল পাঠিয়েছিলেন এটা জিজ্ঞেস করে যে এখানে (ইসিবি) সবকিছু আসলে চালায় কে! এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা এই সপ্তাহে আবার সামনে আনা দরকার।’