‘আসল বিশ্বকাপে’ প্রথম দানেই বাজিমাত মুশফিকের
ক্রিকেট খুব মজার খেলা। টিম ম্যানেজমেন্ট দলের প্রয়োজনে চার–পাঁচে খেলা কোনো ব্যাটসম্যানকে নিচে নামালে সমালোচনা হয়। বাইরে থেকে কথা ওঠে। সেই ব্যাটসম্যানেরও খারাপ লাগাই খুব স্বাভাবিক। মজাটা হলো, এসব ভুল প্রমাণে যা করার সেই ব্যাটসম্যানকেই করতে হয়। অন্য কেউ কিচ্ছুটি করে দেবে না।
মুশফিকুর রহিম এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে তাঁর ফর্ম নিয়ে ফিসফাস ছিল। স্ট্রাইকরেটও নেমে যাচ্ছিল। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের ১৪০ রান তাড়া করতে গিয়ে চারে নেমে তাঁর ৩৬ বলে ৩৮ রানের ইনিংস প্রশংসার চেয়ে সমালোচনাই বেশি কুড়িয়েছে। ওমানের বিপক্ষে পরের ম্যাচে নেমে যায় ব্যাটিং–অর্ডার। এবার মুশফিক নামলেন আটে। দেশ থেকে তামিম ইকবাল টিম ম্যানেজমেন্টের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। বললেন, যেকোনো পরিস্থিতি চারে–পাঁচে নামা ব্যাটসম্যানের ওপর আস্থা রাখা উচিত। পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে পরের ম্যাচেই মুশফিক নামলেন চারে। তাতে ফল পাল্টায়নি, বরং মুশফিকের বাজে ফর্ম নিয়ে ফিসফিসানি আরও বাড়ল।
এসব টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের অল্পসল্প গল্প। মুশফিক সে গল্পে ‘খলনায়ক’ বনে গেলেও পরিত্রাণের পথ খোলা ছিল সামনেই—টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ। অনেকের মতেই ‘আসল’ বিশ্বকাপ—বড় বড় সব দল আর বড় খেলোয়াড়দের ভালো করার মঞ্চ। মুশফিক সেখানে বাজিমাত করলেন প্রথম দানেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আজ নিজের চিরাচরিত জায়গা চার নেমে ৩৭ বলে তাঁর অপরাজিত ৫৭ রানের ইনিংসটি অনেক কিছুরই জবাব। ফর্ম ও স্ট্রাইকরেট নিয়ে সমালোচনা, ব্যাটিং অর্ডারে নিচে নেমে যাওয়া, হাতে খুব বেশি শট নেই—এসব কথার। প্রতিপক্ষ যেহেতু শ্রীলঙ্কা, যাদের বিপক্ষে মুশির ব্যাট সব সময়ই চওড়া—অর্থাৎ তিনি যেন জানতেন আলো আসবেই।
শারজায় আজ মুশফিকের ব্যাটে সেই আলোর স্ফুরণ ঘটল। তাতে টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজেদের চিরাচরিত ব্যর্থতার জায়গা থেকেও বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিতে বাংলাদেশ দল বরাবরই যেন বনানী–মতিঝিল রুটের ৬ নম্বর বাস। কিন্তু আজ সেই লক্কর–ঝক্কড় বাস–ই মুশফিকের চালনায় পেল ভলভোর গতি। শেষ ৩০ বলে এসেছে ৫৩ রান—এই বিশ্বকাপে পাপুয়া নিউগিনি ছাড়া আর কোনো দলের বিপক্ষেই শেষটা এত ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও পাপুয়া নিউগিনির বোলারদের মধ্যে পার্থক্য তো সবারই জানা।
মুশফিক কোন ধাতে গড়া, তা যেহেতু সবারই জানা, তাই আন্দাজ করে নেওয়া যায়—আজ তাঁর ১৫৪.০৫ স্ট্রাইকরেটের ইনিংসটি নিন্দুকদের প্রতি একরকম বিবৃতিও। যে খেলোয়াড় প্রতিটি সিরিজের আগে নিজেকে গড়েন নতুন করে, ঘাম ও নিবেদনের মিশ্রণে যাঁর প্রস্তুতির সঙ্গে অন্য কারও জুড়ি মেলা ভার—তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কিছু একটা করতে হাত তো চুলকাবেই। আজ মুশফিকের ৩৭ বলের ইনিংসে শক্ত চোয়ালের সেই চেষ্টা ফুটল খুব ভালোভাবেই। জেদ কিংবা প্রতিজ্ঞা যা–ই বলুন, একটা বিষয় পরিষ্কার—আজ মাথা খুলে ব্যাট করেছেন মুশফিক।
বাইরের দেশের ক্রিকেটাররা কোনো টুর্নামেন্ট চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতটা চোখ রাখেন তা অজানা। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে চোখ রাখেন তা বোঝা গেছে ওমানের সঙ্গে জয়ের পর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কথায়। দল খারাপ (স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হার) খেললে সব মাধ্যমে সমালোচনা হবেই। মাঝে মাঝে তা সীমা ছাড়িয়ে যায়। মুশফিককে নিয়ে যেমন কথা উঠেছিল, তিনি দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হলেও হাতে শটের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য খুব কম। রান বের করতে না পারলে বার বার ফিরে যান নিজের প্রিয় স্লগ সুইপ কিংবা স্কুপ শটে।
কথাটা কখনো সত্য, কখনো মিথ্যা। আজ যেমন মিথ্যা প্রমাণ হলো। ১৯.৫ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৪ উইকেটে ১৬৭। শেষ বলে দুষ্মন্ত চামিরাকে স্কুপে চার মেরে সংগ্রহটা ১৭১–এ নিয়ে যান মুশফিক। এখানে দুটি বিষয় খেয়াল করার মতো—এই ইনিংসে মুশফিক আগেও দুবার স্কুপ খেলেছেন, তখন কাজে লাগেনি। ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা থেকে শেষ বলে ওই শট খেলার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। টি–টোয়েন্টিতে দলীয় সংগ্রহ ১৭০-এর ডানপাশে নিয়ে যাওয়া সব সময়ই দলকে মানসিকভাবে এগিয়ে রাখে। মুশফিক তাই ঝুঁকিটা নিয়েছেন শেষ বলে, যখন তা আর ঝুঁকি থাকে না, কারণ তখন রান তোলাটাই মুখ্য। মুশফিক তাতে সফলও।
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যত ম্যাচ খেলেছে মুশফিকও তত (২৯) ম্যাচই খেলেছেন। এর মধ্যে ২৪ ইনিংসে ব্যাট করে আজই পেলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটির দেখা। তাঁর ইনিংসে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, শট খেলায় বৈচিত্র্য। স্লগ সুইপ একদমই খেলেননি তা নয়—দুটি ছক্কাও পেয়েছেন এ শট থেকে। বিনুরা ফার্নান্দোর করা ১৭তম ওভার কিংবা চামিরার করা পরের ওভারে তাঁর দুটি স্কয়ার কাট মনে করে দেখুন—ম্যাচের সে পরিস্থিতিতে সবাই একটু গায়ের জোরে শট খেলতে চান। কিন্তু ফাঁকা জায়গা থেকে মুশফিকের সে দুটি ওভারে দুটি চার বের করা তাঁর পরিণত মাথারই প্রমাণ। এর বাইরে সব সময় স্ট্রাইক অদল বদল করে খেলার চেষ্টা তো ছিল।
এই চেষ্টাটুকু থাকলে চার থেকে মুশফিককে নামায় কে!