এই দিনে কুম্বলেকে মনে পড়বেই
এই অভিজ্ঞতা কারও ছিল না। টেস্ট ক্রিকেটে একজন বোলার একাই প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট তুলে নিচ্ছেন, ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্তও তা ছিল স্বপ্নের মতো এক ব্যাপার। হ্যাঁ, ১৯৫৬ সালে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট নেওয়া জিম লেকারের সেই কীর্তি রেকর্ডবইয়ে ছিল, স্মৃতির পাতায় ছিল, কিন্তু সেটি তো দূরতম স্মৃতি। বইয়ে পড়ে কিংবা অভিজ্ঞজনদের কাছ থেকে জানা। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে রিচার্ড স্টোকস নামের এক অবিশ্বাস্য ভাগ্যবানেরই শুধু এমন কিছু প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ছিল।
দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় এক শীতকাতুরে, কুয়াশায় মোড়া দুপুরে অনিল কুম্বলে বিরল এক কীর্তির সঙ্গে একটা প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
আজ সেই ৭ ফেব্রুয়ারি। কুম্বলের এই কীর্তি হয়তো পুরোনো হবে না কোনো দিন। ভুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। ভুলে যেতে চাইলেও পারবে না। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) যেমন আজ নিজেদের অফিশিয়াল পেজে টুইট করে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে। মানুষও মেতেছে স্মৃতি রোমন্থনে। হাজার হোক প্রতিপক্ষের এক ইনিংসের সব কটি উইকেট তুলে নেওয়ার কীর্তি যে আধুনিক যুগেও সম্ভব, তার প্রথম চাক্ষুষ উদাহরণ যে সেটি!
২১ বছর ধরেই কুম্বলের সেই কীর্তি একটা প্রজন্মের স্মৃতিকাতরতা। কুম্বলের ১০ উইকেট নেওয়ার ঘটনাটি যাঁরা টেলিভিশনের সামনে বসে কিংবা মাঠে বসে দেখেছিলেন, তাঁরা দারুণ ভাগ্যবান। দুই দশকের বেশি সময় পরে এসে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাঁরা আবার সাক্ষী হয়েছেন ১০ উইকেট-কীর্তির। এবারও স্থান ভারত, কুম্বলের পাশে বসলেন আরেক ভারতীয়। কাকতালীয়ভাবে তাঁর জন্ম মুম্বাই শহরেই। তবে এবার ১০ উইকেট তুলে নেওয়ার কীর্তিটা ভারতের বিপক্ষে। কারণ, জন্মস্থানে খেলতে নামলেও তিনি খেলছিলেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখের আগপর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি ছিল দুটিই—জিম লেকার আর অনিল কুম্বলে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে যোগ হয়েছে আরও একটি নাম—এজাজ প্যাটেল। তিনি অবশ্য অন্য দুজনের চেয়ে একটু আলাদা করে। বাঁহাতি বোলার হিসেবে এমন কিছু করা ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার এজাজ। লেকার আর কুম্বলে—দুজনই ১০ উইকেট নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় ইনিংসে। এজাজ নিয়েছেন প্রতিপক্ষের প্রথম ইনিংসে। তবে একটা জায়গায় এজাজ লেকার আর কুম্বলের চেয়ে একটু পিছিয়েই থাকবেন, ১০ উইকেট নিয়ে লেকার আর কুম্বলে জিতিয়েছিলেন নিজেদের দেশকে। এজাজের ১০ উইকেটের পরও টেস্টটা হেরেছিল নিউজিল্যান্ড।
১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কুম্বলে জিম লেকারের অভিনন্দন পাননি। ১৯৮৬ সালেই যে ইংলিশ গ্রেট চলে গেছেন অনন্তলোকে। নিজেকে সঙ্গীহীন ভেবেই ধরাধাম ছেড়েছেন লেকার। কুম্বলে ভাগ্যবান। জীবদ্দশায় এজাজকে অভিনন্দিত করতে পেরেছেন। টুইট করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ক্লাবে স্বাগত, দারুণ বোলিং করেছ এজাজ।’
১৯৫৬ সালের পর সেই ‘পারফেক্ট টেন’ ক্লাবের দরজা বন্ধই ছিল। ৪৩ বছর পর কুম্বলে সেটি খুলেছিলেন দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে বহু প্রতীক্ষিত সিরিজে ভারত পিছিয়ে ছিল ১-০ ব্যবধানে। দুই টেস্টের সেই সিরিজে সমতা এনেছিল ভারত কুম্বলের সেই ‘দশে দশ’ দিয়েই। পাকিস্তান দলে সেদিন সাঈদ আনোয়ার, শহীদ আফ্রিদি, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম-উল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরাম, সাকলায়েন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিসের মতো তারকার ছড়াছড়ি। তারকাদ্যুতিকে পাত্তা না দিয়েই কুম্বলে সেদিন বাজিমাত করেছিলেন। পাকিস্তানের সব ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে অভাবনীয় এক দৃশ্যপটের সঙ্গে তিনি সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
দুই টেস্টের সিরিজের প্রথম টেস্টে চেন্নাইয়ে ভারতকে হারিয়েছিল পাকিস্তান। সিরিজ বাঁচাতে ভারতকে দ্বিতীয় টেস্ট জিততেই হতো। সেদিন কুম্বলের কাছেই হেরেছিল পাকিস্তান। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬.৩ ওভার বল করে ৯ মেডেন নিয়ে ৭৪ রান দিয়ে ১০ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন কুম্বলে।
শেষ ইনিংসে পাকিস্তানকে ৪২০ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল ভারত। সাঈদ আনোয়ার আর শহীদ আফ্রিদির ১০১ রানের উদ্বোধনী জুটির পর মনে হয়েছিল, কোনোভাবে হয়তো পাকিস্তান টেস্টটা বাঁচিয়ে ফেলবে। কিন্তু এরপরই শুরু কুম্বলের জাদু। শহীদ আফ্রিদির উইকেট দিয়ে শুরু, এরপর একে একে ফিরলেন ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম উল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ (তখন ইউসুফ ইয়োহানা), সাঈদ আনোয়ার, সেলিম মালিক, মঈন খানসহ বাকিরা।
আজ সেই ৭ ফেব্রুয়ারি। কুম্বলে যদি তাঁর কীর্তির মুহূর্তগুলো আবার দেখতে বসেন, তাতে নিশ্চয় কারও আপত্তি থাকবে না। নিউজিল্যান্ডে বসে এজাজ প্যাটেলও হয়তো দিনটাকে মিলিয়ে নিচ্ছেন নিজের কীর্তির সঙ্গে। অন্যলোকে বসে জিম লেকারও কি তা–ই করছেন?