অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন শেন ওয়ার্ন। ওয়ার্নের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা তাই তাঁর বুকে বেঁধারই কথা। যেখানে তিনি আগে থেকেই কাতর হয়ে ছিলেন সতীর্থ রডনি মার্শের মৃত্যুশোকে। এ নিয়েই ক্রিকইনফোতে লেখা ইয়ান চ্যাপেলের কলামের অনূদিত রূপ—
ব্যাপারটা একদম অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য তো বটেই। শোকস্তব্ধ হওয়া দূরে থাক, রড মার্শের মৃত্যুর খবরটা ঠিকঠাক হজমই হলো না, এর মধ্যেই খবর এল হার্ট অ্যাটাক করে শেন ওয়ার্ন মারা গেছে!
সিডনিতে আজ সকালে জেগেই ছিলাম, ফোনে একের পর এক মেসেজ আসছিল। ভাবলাম, সবাই হয়তো আমার বন্ধু রড মার্শের মৃত্যুর জন্যই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে মেসেজ পাঠাচ্ছে। পরে ফোনটা একটু কাছে এনে দেখলাম মেসেজগুলো শেনকে নিয়ে।
এমনিতেই কষ্টে ছিলাম, ওয়ার্নের খবরটা আমাকে হতবিহ্বল করে দিল। ওয়ার্নি শুধু একজন চ্যাম্পিয়ন লেগ স্পিনারই ছিল না, একই সঙ্গে একজন অসাধারণ ও ভানহীন মানুষ ছিল।
ওয়ার্নের মধ্যে এই গুণটা ছিল; সে শুধু বাচ্চাদের অটোগ্রাফই দিত না, বরং তাদের অনেকের সঙ্গে সময় নিয়ে কথাও বলত। শুধু বলার জন্যও বলত না, বরং এমন সব জিনিস নিয়ে কথা বলত, যা নিয়ে ওই বাচ্চাটার আগ্রহ আছে।
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ১৯৭৩ সালে জয় পাওয়ার কৃতিত্ব আছে আমার, ১৯৯৫ সালে যে কীর্তির পুনরাবৃত্তি করেছিল মার্ক টেলরের দল। আমাকে দুই দলের মধ্যে একটা ম্যাচ আয়োজন করতে বলা হয়েছিল। যে কাজটা আমি খুব পছন্দ করেছিলাম।
আমি তখন একটা ‘কম-টেক’ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলাম। দুই দলকে একত্র করতে কোনো সমস্যা হয়নি, কম-টেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ডেভিড শিনও প্রত্যেক খেলোয়াড়ের পেছনে টাকা ঢালতে আগ্রহী ছিলেন। ওয়ার্নকে চেক দেওয়ার সময় সে সরাসরি ‘না’ করে দিল। বলল, ‘যে ইয়ানের বন্ধু, সে আমারও বন্ধু।’ এটা বলে ও আর টাকাই নিল না।
একবার ওকে ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে দেখলাম, স্বাভাবিকভাবেই সবাই ওকে চিনত। অথচ অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে প্রথম যার সঙ্গে ওর দেখা হলো, তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ও বলল, ‘হাই, আমি শেন।’ সেটা দেখে আমি হাসতে হাসতে ওকে বললাম, ‘বন্ধু, তোমাকে এখানে সবাই চেনে, নিজের পরিচয় দিতে হবে না।’
শেন এমনই ছিল। সে নিজে কখনো নিজেকে তারকা ভাবত না। আমার হাসি দেখে সে বলল, ‘বন্ধু! আমি সাধারণ একজন ছেলে যে সিগারেট, পাই আর বিয়ার পছন্দ করে।’
এ জন৵ই ওয়ার্ন কোনো কিছু করার আগে ভাবত না। এই স্বভাব ওকে অনেকবার সমস্যাতেও ফেলেছে। রাতে শহরে বেরোনোর সময় ওর ছবি যখন তুলে ছাপানো হতো, সেটা দেখে সে খুব অবাক হতো। ওর কাছে মনে হতো, আর বাকি দশজন সাধারণ ছেলের মতো সে–ও রাতে মজা করতে পারবে।
চ্যানেল নাইনের সঙ্গে করা চুক্তির কারণে অগাস্টা, জর্জিয়ায় হওয়া ১৯৯৬ মাস্টার্স গলফ টুর্নামেন্টের সময় আমরা একই বাসায় থাকতাম। একদিন আমাদের সঙ্গে ও একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গেল। কিছু খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না ওর, অনেক না না করছিল। তা–ও আমি ওর জন্য খাবার অর্ডার করলাম। শুধু চিপস ছাড়া আর কিছুই অর্ডার করল না ও।
খাবার যখন এল, একটা খেয়ে চিপসের ওপর মরিচের গুঁড়া দেওয়ার জন্য আমাকে দুষতে থাকল, আর বলল, ও পিৎজা খেতে যাচ্ছে। ২০ মিনিট পর যখন ও ফিরল, আমি বললাম, ‘তুমি সিগারেট খেতে গিয়েছিলে।’ পরে ও স্বীকার করল, ও আসলে একটা সিগারেট খেতেই গিয়েছিল।
আমার স্ত্রী বারবারা-অ্যান, যে পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে, একবার বলল, ওয়ার্নের উচিত ওর জঘন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা। ওয়ার্ন পাত্তাও দেয়নি। পরে দেখা গেল, বারবারা-অ্যান ঠিকই ছিল।
ওয়ার্ন আক্রমণাত্মক একজন ক্রিকেটার ছিল, খেলা নিয়ে যার চিন্তা মুগ্ধ করত। বিংশ শতাব্দীর সেরা ডেলিভারিটা দিয়ে মাইক গ্যাটিংকে আউট করেছিল, এমন আরও অসাধারণ ডেলিভারি করার সামর্থ্য ছিল, যা ওকে টেস্টে ৭০০-এরও বেশি উইকেট এনে দিয়েছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া মেলবোর্ন ট্রুথ–এর জন্য লেখার সময় সাবেক পেস বোলার রড হগ ওয়ার্নকে নিয়ে একটা কথা লিখেছিলেন। ওয়ার্ন তখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরুই করেনি। হগ বলেছিলেন, ওয়ার্ন টেস্টে ৫০০ উইকেট নেবে। লেখা পড়ে পত্রিকাটার সম্পাদক হগকে বকাবকি করা শুরু করলেন, ‘তুমি একটা গাধা! কেউ কোনো দিন ৫০০ টেস্ট উইকেট নিতে পারবে না।’
ওয়ার্ন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার টেরি জেনারের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছিল। ওয়ার্নের সঙ্গে জেনারের বোঝাপড়া বেশ ভালো ছিল, অনেক কঠিন সময়ে সে ওয়ার্নের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ওয়ার্ন যখন অভিষেকে অনেক রানের বিনিময়ে একটিমাত্র উইকেট পেল, জেনার আমাকে ওর বোলিং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। জানতে চাইল, আমি কী ভাবছি। আমি বললাম, ‘ওসব পরিসংখ্যান নিয়ে চিন্তা কোরো না। ও অনেক ভালো বলও করেছে। সে ঠিকই ভালো করবে।’
তবে এতটা ভালো করবে, সেটা বুঝিনি। ঠিক যেন ডেনিস লিলির মতো, ওয়ার্নের বোলিংয়ের সময় দর্শকেরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করত। ভাবত, কিছু একটা হবে এবার। (রড) মার্শ লিলিকে অনেক পছন্দ করত, পছন্দ করত তাদের, যারা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে। এ কারণেই এই সপ্তাহটা আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। রড মার্শকে হারানো কষ্টের তো বটেই, কিন্তু একই সঙ্গে শেন ওয়ার্নকে হারানোর ব্যাপারটা বেশি বেশিই।
অনুগ্রহ করে আমাকে একটু শান্তিমতো শোক পালন করতে দিন।