‘ক্রিকেট–শুদ্ধতার বড় দেয়াল ধসে পড়ল’

প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার আলোকিত করেছেন জালাল আহমেদ চৌধুরীফাইল ছবি: প্রথম আলো

দুপুর থেকেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অপেক্ষায় ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার গাজী আশরাফ হোসেন, সাবেক কোচ ওসমান খান, সাবেক ফুটবলার হাসানুজ্জামান বাবলু, ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুজ্জামান মিকু, হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনুরসহ ক্রীড়াঙ্গনের অনেকে। অপেক্ষায় ছিলেন সংবাদমাধ্যম কর্মীরাও।

মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সে প্রিয় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শেষবারের মতো এলেন ক্রিকেট লেখক ও কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরী। তবে চিরচেনা হাসিমুখের বদলে নিথর দেহে শুয়ে রইলেন সাদা কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায়।

আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা গেছেন ৭৪ বছর বয়সী এই সাবেক কোচ। দুপরে একদফা জানাজা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেখানে জানাজার পর জালাল আহমেদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণা করলেন তাঁর একসময়ের সহকর্মী, সাবেক ক্রিকেটারসহ অনেকে। জালাল আহমেদের দ্বিতীয় দফা জানাজা হবে আজিমপুর ইরাকি মাঠে। এরপর রাতেই হবে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর দাফন।

১৯৭৯ সালে জালাল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে ভারতের পাতিয়ালায় কোচিং কোর্স করতে গিয়েছিলেন কোচ ওসমান খান। প্রিয় মানুষটির চলে যাওয়ায় আজ কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘জালাল ভাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য যা কিছু করেছেন, তা নিয়ে কোনো প্রতিদান চাননি। উনি টাকাপয়সার লোভী ছিলেন না। সব সময় চিন্তা করতেন ক্রিকেট নিয়ে। জালাল ভাই চলে গেলেন। আমি একা হয়ে গেলাম।’

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ক্রিকেট লেখক ও কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়
ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেটারদের যেভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন জালাল আহমেদ চৌধুরী, সেটা কখনোই ভুলবেন না সাবেক ক্রিকেটার গাজী আশরাফ, ‘১৯৭৮ সালে পাতিয়ালায় যাওয়ার আগে আমাকে একটা খাম দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তখন মাঠে মোহামেডানের ফুটবল খেলা দেখতে এসেছি। এর আগে আমি ওয়ারীর বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলাম। সেই খামে ছিল একটা চিঠি। যেখানে লেখা, অভিনন্দন, আশা করি, আরও ভালো খেলবে। খামের মধ্যে ছিল ১০০ টাকা। ওই টাকা বড় কিছু না আমার জন্য। কিন্তু যে আবেগ আর ভালোবাসা ছিল, সেটা আমি একা নই, যুগে যুগে সর্বস্তরের সব খেলোয়াড় পেয়ে এসেছে তাঁর কাছ থেকে।’

জালাল আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পরিবারের সবার বড় ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনকে স্নেহের বাঁধনে আগলে রাখতেন সব সময়। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকে জালাল আহমেদ চৌধুরীর অসুস্থতার খবর পেয়ে আজ ঢাকা এসেছেন আবু ওবায়দা চৌধুরী।

পরিবারের সবার ছোট ওবায়দা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে স্মৃতিচারণা করলেন বড় ভাইয়ের, ‘উনাকে আদর করে আমরা ময়না বলে ডাকতাম। ভাইয়া বলতাম না। উনি কখনো শাসন করতেন না। ভাবি বেঁচে নেই। সব সময় ফোন করে বলতেন, “কবে আসবি?” ফোনে বলতেন, আজ মিটিং, আজ পিকনিক। এসব গল্পই হতো। আমার ভাইকে যেভাবে মানুষ ভালোবাসে, এটা দেখে আমি মুগ্ধ।’

দেশের ক্রিকেটে বেশির ভাগের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেট কোচের বাইরে জালাল আহমেদ চৌধুরীর আরেকটা পরিচয় ক্রীড়া লেখক। বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও কালের কণ্ঠের উপসম্পাদক মোস্তফা মামুন বললেন, ‘জালাল ভাইকে যদি সাংবাদিকতার জায়গা থেকে চিন্তা করি, তাহলে আমাদের ক্রিকেট লেখালেখির সঙ্গে ক্রিকেট প্রশাসনের সংযোগের সেতু ছিলেন। ক্রিকেটকে আমরা খেলা হিসেবে দেখি। জালাল ভাই খেলা হিসেবে দেখতেন না কখনো। উনি মনে করতেন, এটা একটি শিল্প। এটা জীবনবোধ। উনি যখন লিখতেন, অনেক অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করতেন। যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতেন ওই জায়গায় ওটাই সঠিক শব্দ।’

জালাল আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুতে বড় ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন মামুন, ‘আমাদের আশি–নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটের গণভিত্তি ছিল না। টাকাপয়সা ছিল না। তখনো যে ক্রিকেটচর্চা টিকে ছিল, সেগুলো অল্প কিছু মানুষের জন্য। যাঁরা ক্রিকেটকে নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। আসলে আমাদের ক্রিকেট–চিন্তা, ক্রিকেট–শুদ্ধতার বড় দেয়াল ধসে পড়ল।’