খালেদের ‘নাকলে’ নাকাল ব্যাটসম্যানরা
এনক্রুমা বোনার ও কেভন হজের উইকেট ততক্ষণে বিসিবি একাদশের পেসার খালেদ আহমেদের পকেটে। কিন্তু ৮৫ রান করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্রেগ ব্রাফেট আউট হচ্ছিলেন না কিছুতেই। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের আগে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের প্রস্তুতি ম্যাচটার পুরো সুবিধাই নিচ্ছিলেন তিনি।
চোটের কারণে প্রায় দুই বছর জাতীয় দলের বাইরে থাকা খালেদও নির্বাচকদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে চাচ্ছিলেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে আউট করে। কিন্তু উইকেট যে পুরোই ব্যাটিং স্বর্গ! সিম, সুইং কিছুই নেই। জোরে বল করেও লাভ হচ্ছিল না।
কী ভেবে যেন আগের কয়েক মাস ধরে অনুশীলন করা বিশেষ বলটাই করে বসলেন খালেদ।
আঙ্গুলের গাঁটে বল চেপে ধরে বল ছাড়লেন স্টাম্প বরাবর। এরপর যা হলো তাতে খালেদ, ব্রাফেট দুজনই অবাক! স্বাভাবিক ডেলিভারির মতোই বল, কিন্তু সেই বলের গতিই স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে যান ১৮৭ বল খেলে থিতু হওয়া ব্রাফেট। ফলাফল পরিষ্কার এলবিডব্লিউ।
খালেদের সেই বিশেষ ডেলিভারিটি ছিল ‘নাকল বল’।
এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও এই বল করে ভালোই সফল হচ্ছে খেলাঘরের এই পেসার। ১১ ম্যাচে ১৬ উইকেট নেওয়া খালেদ এখন লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, যার সিংহভাগই এসেছে নাকল বলে।
ব্রাফেটের মতোই এই বলের সামনে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন প্রিমিয়ার লিগের ব্যাটসম্যানরাও। কেউ আগে ব্যাট চালিয়ে বোকা হয়েছেন, কেউ মারতে গিয়ে টাইমিংয়ের গড়বড়ে দিয়েছেন ক্যাচ, কেউবা বল বুঝতে না পেরে এলবিডব্লু অথবা বোল্ড।
খালেদ এবার ব্যতিক্রম কিছু একটা করছেন—লিগ যত এগিয়েছে, ততই সবাই তা জেনেছে। খেলাঘরের বিপক্ষে ম্যাচের আগে তাই সবারই দুশ্চিন্তা থাকে—আজ তো খালেদকে সামলাতে হবে! কিন্তু কীভাবে, এখনো সেটার সঠিক খোঁজ পাননি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা।
লিগ পর্বের শেষ ম্যাচেও খালেদ ভুগিয়েছেন প্রাইম ব্যাংকের তারকা ওপেনার তামিম ইকবালকে। গতির হেরফেরে বিভ্রান্ত হয়ে আগে ব্যাট চালাচ্ছিলেন তামিমের মতো ব্যাটসম্যানও।
ও নাকল বল নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছে। শ্রীলঙ্কায়ও সে এটা নিয়ে অনেক কাজ করেছে। আমি তার উন্নতিও দেখতে পাচ্ছি।
নাকল বল ছাড়াই হয় একটু অন্যভাবে। পেস বোলাররা সাধারণত বল গ্রিপ করেন আঙুলের অগ্রভাগের সাহায্যে। কিন্তু নাকল বলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। আঙ্গুলের অগ্রভাগ দিয়ে না ধরে নখ দিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরা হয় বলটাকে। ফলে বল ছোড়ার সময় হাতে গতি একই থাকলেও বলের গতি কমে আসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ। হাত ঘোরানোর গতি একই থাকায় ব্যাটসম্যানরা ধোঁকা খেয়ে যান। ব্যাট চালিয়ে বসেন বল আসার আগেই।
গত বছর বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের সময় থেকেই নাকল বলের অনুশীলন শুরু করেন খালেদ। ম্যাচেও সেটি নিয়মিত করার মতো নিয়ন্ত্রণটা চলে আসে দ্রুতই। এবারের প্রিমিয়ার লিগে তো প্রতি ম্যাচেই নাকল বল করেছেন।
অবশ্য খালেদ জানালেন, উইকেটের চরিত্রও নাকি তাঁকে সাহায্য করেছে, ‘লিগ পর্বের ম্যাচগুলোতে আমার ২৪টি বলের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল নাকল বল। কেউ বুঝত না কী করছি। আর উইকেটও ছিল এমন, জোরে বল করলেই মার খেতে হতো। তাই নাকল বল বাড়িয়ে দিয়েছি।’
বেসবল পিচারদের অন্যতম অস্ত্র নাকল বল। বেসবল থেকে বলটা ক্রিকেটে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্টের হাত ধরে। তবে এটি বেশি পরিচিতি পায় ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতীয় পেসার জহির খান বলটা করে সাফল্য পেলে।
এখন তো অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু টাই, কেইন রিচার্ডসন, ইংল্যান্ডের ম্যাট কোল, বেনি হাওয়েল, ভারতের ভুবনেশ্বর কুমার, শার্দুল ঠাকুররা নিয়মিতই নাকল বলে ব্যাটসম্যানদের নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছেন।
বাংলাদেশ দলের পেসার রুবেল হোসেন এর আগে এই বল করার চেষ্টা করে সফল হননি। কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে দুই টেস্ট খেলা খালেদ নাকল বলের কৌশলটা পুরোই রপ্ত করে ফেলেছেন, সফলও হচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। এবার তাঁর এই অস্ত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়ে যাওয়ার পালা।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের বোলিং কোচ ওটিস গিবসনের চোখেও খালেদের উন্নতিটা ধরা পড়েছে। ছুটিতে থাকলেও নিয়মিত খালেদের পাঠানো বোলিংয়ের ভিডিও দেখেছেন গিবসন, দেখছেন তাঁর নাকল বলের সাফল্যও, ‘ও নাকল বল নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছে। শ্রীলঙ্কায়ও সে এটা নিয়ে অনেক কাজ করেছে। আমি তার উন্নতিও দেখতে পাচ্ছি। এখন ম্যাচেও ভালো করছে, এটা খুশির খবর।’