চমৎকার চার: বাকি শুধু উইলিয়ামসন
জো রুটের সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার মতো খুব বেশি মানুষ হয়তো নেই। ইংল্যান্ড অধিনায়কের পদ থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাটা অবধারিত না হলেও অনুমিতই ছিল।
রুটের সরে দাঁড়ানোর পর মোটামুটি শেষ হয়ে গেল একটা অধ্যায়েরই। বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, রুট, কেইন উইলিয়ামসন—ক্রিকেটের একটা প্রজন্মের কাছে ‘ফ্যাবুলাস ফোর’/ ‘ফ্যাব ফোর’ বা ‘চমৎকার চার’। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে দলের ভরসা হয়ে আছেন এক দশক ধরে, সে সঙ্গে নিজ নিজ দেশের টেস্ট দলের অধিনায়কত্বও করেছেন সবাই।
তবে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে সরে দাঁড়ালেন কোহলি, স্মিথ, রুট। বাকি রইলেন শুধু উইলিয়ামসন, সেটিও কত দিনের জন্য—সে প্রশ্নও তোলাই যায়।
স্টিভ স্মিথ: কান্নাভেজা শেষ
স্টিভেন স্মিথ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ২০১৮ সালে সিডনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সদ্য নিষিদ্ধ অধিনায়ক। কেপটাউন টেস্টে বল টেম্পারিং কেলেঙ্কারির দায় নিজের ওপর নেওয়ার কথা বলছিলেন স্মিথ, সামলে রাখতে পারছিলেন না নিজেকে।
অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক থেকে নিষিদ্ধ—স্মিথ যেন আকাশে উড়তে উড়তে অতলগহ্বরে নিক্ষিপ্ত হলেন।
২০১৪ সালে মাইকেল ক্লার্কের অনুপস্থিতিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবার টেস্টে নেতৃত্ব দেন স্মিথ। সেবার ৩টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিলেন। পরের বছর অ্যাশেজ দিয়ে মাইকেল ক্লার্ক অবসর নেওয়ার পর পাকাপাকি দায়িত্ব পান। শুরু হয় স্মিথের স্বপ্নযাত্রা।
২০১৮ সালের কেপটাউন টেস্ট পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেন ৩৪ ম্যাচে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া জেতে ১৮টি ম্যাচ, ড্র হয় ৬টি। ব্যাটসম্যান স্মিথও নতুন রূপ পায় ওই সময়ে। এমনিতে ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৫৯.৭৭, অধিনায়ক হিসেবে সেটিই ৬৯.৫৯। তবে যে ম্যাচগুলোতে জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, অধিনায়ক স্মিথের ব্যাটিং গড় সেখানে ৮১.৬৬! ২৭টি শতকের ১৫টিই স্মিথ করেছেন অধিনায়ক হিসেবে।
স্মিথের সে স্বপ্নযাত্রা থামে ২০১৮ সালের ওই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। টেলিভিশন ক্যামেরায় বল টেম্পারিং করতে গিয়ে ধরা পড়েন ক্যামেরন ব্যানক্রফট, পরে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ হন ব্যানক্রফটসহ সহ-অধিনায়ক ওয়ার্নার ও অধিনায়ক স্মিথ। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় স্মিথকে, সঙ্গে আরও এক বছরের জন্য অধিনায়কত্ব করতে পারবেন না—বলা হয় এমন।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ব্যাটসম্যান স্মিথের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটে ২০১৯ অ্যাশেজে, ৪ টেস্টে ১১০.৫৭ গড়ে করেন ৭৭৪ রান। স্মিথের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়েছিল টিম পেইনকে, সর্বশেষ অ্যাশেজের আগে আপত্তিকর খুদে বার্তা চালাচালির ইতিহাসের জেরে সরে দাঁড়ান তিনি। এরপর প্যাট কামিন্সকে দায়িত্ব দেয় অস্ট্রেলিয়া। সেই কামিন্সের করোনা-সংক্রান্ত অনুপস্থিতিতে অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টে নেতৃত্বে ফেরেন স্মিথ। তবে ওই এক টেস্টের জন্যই।
অধিনায়ক স্মিথের ক্যারিয়ারটা যে আক্ষরিক অর্থেই উল্লাস-হতাশার দুর্দান্ত এক মিশ্রণ!
বিরাট কোহলি: শেষে এসে বিতর্ক
অধিনায়ক স্মিথের শুরু যে সিরিজে, বিরাট কোহলিরও তাই। মহেন্দ্র সিং ধোনির অনুপস্থিতিতে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই সিরিজে প্রথম টেস্টে দায়িত্ব পালন করেন কোহলি। বক্সিং ডে টেস্টের পর হুট করেই অবসর নেন ধোনি, টেস্ট অধিনায়কত্ব স্থায়ীভাবে চলে যায় কোহলির হাতে।
অধিনায়কত্বের অভিষেকেই জোড়া শতক করা কোহলি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত তিনি। সব মিলিয়ে ভারতকে রেকর্ড ৬৮টি টেস্টে নেতৃত্ব দেন কোহলি, জেতেন ৪০টি ম্যাচ, এটাও রেকর্ড। কোহলির অধীনে নিজেদের মাটিতে অপরাজেয় হয়ে ওঠে ভারত—১১টি সিরিজের সব কটিই জেতে তারা।
বিদেশের মাটিতেও ভারতকে ‘ইতিহাস’ এনে দেন কোহলি। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ২২ বছরের মধ্যে প্রথমবার সিরিজ জেতে ভারত। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার সিরিজ জয়ের ইতিহাসও তৈরি করে কোহলির ভারত। ২০২০-২০২১-এ এসে আবারও জেতে তারা, যদিও প্রথম টেস্টের পরই পিতৃত্বকালীন ছুটিতে যান কোহলি।
২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ঘোষণা দেন, এ সংস্করণে আর অধিনায়ক থাকবেন না। সে পর্যন্ত ঠিকই ছিল সব। তবে বিতর্কের শুরু দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে। গত ডিসেম্বরে ভারত ক্রিকেট বোর্ড ঘোষণা দেয়, ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে বরখাস্ত করা হয়েছে কোহলিকে। বোর্ডের সঙ্গে কোহলির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে ওঠে দ্রুতই।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ ড্র থাকা অবস্থায় শেষ টেস্ট খেলতে কেপটাউনে নামে ভারত। তবে সম্ভাবনা জাগিয়েও হারে তারা।
২৪ ঘণ্টা পর টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকেও সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন কোহলি।
জো রুট: দল একদিকে, তিনি আরেক দিকে
জো রুট যখন অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেন, সর্বশেষ ২০ টেস্টে তাঁর ৮টি শতক। তবে ইংল্যান্ড দলেও যেন খেলছিলেন একাই! সর্বশেষ ১৭ টেস্টে জয় নেই ইংল্যান্ডের। অ্যাশেজের পর তারা হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজও। ব্যাটসম্যান রুট ও অধিনায়ক রুটের বিপরীতমুখী পথচলা তাই থামল অবশেষে।
অ্যাশেজের পরই ইংল্যান্ড ছাঁটাই করেছে তাদের প্রধান কোচ, ছেলেদের ক্রিকেটের ব্যবস্থাপককে। জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডসহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকেও বাদ দিয়েছিল ইংল্যান্ড। তবে টিকে গিয়েছিলেন রুট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দুই টেস্ট ড্র করলেও ইংল্যান্ড হারে শেষ টেস্ট। এরপরও ইতিবাচক রুট শুনিয়েছিলেন অধিনায়কত্বে তাঁর আগ্রহের কথা। তবে দেশের মাটিতে পরের মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই সরে গেলেন তিনি, বললেন, উপযুক্ত সময় এটিই।
২০১৭ সালে অ্যালিস্টার কুক সরে দাঁড়ানোর পর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রুটকে।
দেশের মাটিতে ২০১৮ সালে ভারতের বিপক্ষে জয়, ২০১৯-২০ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে জয়ের সঙ্গে টানা দুবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ৪-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় আছে তাঁর সময়ে।
শুরুর দিকে অধিনায়কত্বের প্রভাব পড়ছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে, তবে কাটিয়ে উঠেছিলেন সেটি। এরপর তিনি ভালো করা শুরু করলেন ধারাবাহিকভাবে, কিন্তু আশ্চর্য অধারাবাহিক হয়ে পড়ল ইংল্যান্ড।
যাওয়ার সময় ইংল্যান্ডকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জয়, অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি শতকের রেকর্ডের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি হারের রেকর্ডও সঙ্গী হলো রুটের।
কেইন উইলিয়ামসন: ভবিষ্যতে কী
২৩ জুন, ২০২১, সাউদাম্পটন।
আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম শিরোপা জিতল নিউজিল্যান্ড। জয় নিশ্চিত হওয়ার সময় ক্রিজে ছিলেন রস টেলর ও কেইন উইলিয়ামসন—কিউইদের নতুন প্রজন্মের দুই ক্রিকেট সারথি। অবশেষে একটা বৈশ্বিক শিরোপার আক্ষেপ ঘুচল নিউজিল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের!
তবে ওই টেস্টের পর এখন পর্যন্ত এ সংস্করণে আর একটি টেস্ট খেলেছেন শুধু উইলিয়ামসন। কনুইয়ের চোট ভোগাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই, নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের ক্যারিয়ারের সামনে কী—প্রশ্ন আছে সেটি নিয়েও।
২০১৬ সালে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত কিউইদের ৩৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন উইলিয়ামসন, নিউজিল্যান্ডের যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ২৮ ম্যাচে জিতেছে তারা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সেটিও।