ডমিঙ্গোর শহরে ডমিঙ্গোই আশ্রয়

রাসেল ডমিঙ্গো পোর্ট এলিজাবেথের মানুষ। নিজের শহরে ক্রিকেটারদের জন্য যেন অন্য রকম এক আশ্রয় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ দলের কোচ।

নিজের শহরে ফিরলেন ডমিঙ্গোফাইল ছবি: প্রথম আলো

দৃশ্য-১: জিম্বাবুয়ের হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠ। ব্যাটিং অনুশীলন শেষে নেটের বাইরে এসে ঘাসের ওপর বসে পড়লেন তামিম ইকবাল, সঙ্গে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। দুজনের কথা চলল ঘণ্টাখানেক।

দৃশ্য-২: ঘটনাস্থল দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথ (বর্তমান নাম গেবেহা)। গতকালও সেন্ট জর্জেস পার্কের নেটে ব্যাটিং অনুশীলন শেষে ডমিঙ্গোর সঙ্গে তামিম বসলেন মাঠের পাশের এক টেবিলে। আলোচনাটা অবশ্য এবার বেশ সংক্ষিপ্তই হলো, পুরো ১০ মিনিটও নয়।

গত বছরের জুলাইয়ে জিম্বাবুয়ে সফরের শুরুতে যেকোনো কারণেই হোক কোচের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের। সিরিজের মধ্যে তা আর না বাড়িয়ে হারারের ওই বৈঠকে তামিম নিজেই সেটির ইতি ঘটিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা তাতে এমন হয়ে যায়নি যে এর পর থেকে তাঁরা দুজন ‘সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলেন’। কিছুটা দূরত্ব হয়তো তারপরও ছিল, তবে সেটি দৃশ্যমান হয়নি তেমন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বরং দলীয় সিদ্ধান্তের জায়গাগুলোতে তামিম-ডমিঙ্গোকে সব সময় এক মেরুতেই দেখা যাচ্ছে। ওয়ানডে সিরিজের পর তো তামিম কোচের ভূয়সী প্রশংসাই করেছেন। তাহলে কালকের আলোচনাটার দরকার পড়ল কেন এবং সেটি কেনই–বা ১০ মিনিটও স্থায়ী হলো না?

সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন সেন্ট জর্জেস পার্কে এক চক্কর ঘুরে আসা যাক। এ মাঠ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম আদি ক্রিকেট ভেন্যু, স্টেডিয়ামে ঢুকতে স্বাগত জানায় ‘গ্রায়েম পোলক প্যাভিলিয়ন’। নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, দেশটির কিংবদন্তি ক্রিকেটার গ্রায়েম পোলককে উৎসর্গকৃত সেটি। ৭৬ বছর বয়সী পোলক বর্তমানে পারকিনসনসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত। তাতে কি, ১৩৩ বছর বয়সেও সেন্ট জর্জেস পার্ক তো ঠিকই মনে করিয়ে দেয় তাঁর মতো কীর্তিমানদের, যেমন কীর্তি আছে এই মাঠেরও।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরে প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্কেই। ১৮৮৯ সালের ১২ মার্চ শুরু সেই টেস্টে মাত্র দুই দিনেই স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে গিয়েছিল ৮ উইকেটে। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে বর্ণবৈষম্যের কারণে টেস্ট ক্রিকেট থেকে ২১ বছরের নির্বাসনে যাওয়ার আগে সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটিও দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছিল ভারত মহাসাগরের খুব কাছের এ মাঠেই।

বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও কোচ রাসেল ডমিঙ্গো
ছবি: সংগৃহীত

ডমিঙ্গো-তামিম প্রসঙ্গে শুরু করে হঠাৎ টাইম মেশিনে চড়ে অতীতচারী হওয়ার কারণ আছে। সেন্ট জর্জেস পার্কের ইতিহাস ঘুরতে ঘুরতে বর্তমানে চলে এসে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন বাংলাদেশ দলের কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর বাড়িতেও। পোর্ট এলিজাবেথ তাঁর শহর, ছোটবেলায় খেলেছেন ইস্টার্ন প্রভিন্সের জুনিয়র দলে। ২৫ বছর বয়সে এসে কোচের দায়িত্ব নেন স্থানীয় যুব দলের। এরপর তো একসময় দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলেরই কোচ হয়েছেন।

বাড়ির উঠানের মতো সেন্ট জর্জেস পার্কে সেই ডমিঙ্গো যখন তামিমের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, বিগত কয়েক মাসের মনোমালিন্যের পরও সেখানে তিনি তামিমের প্রতিদ্বন্দ্বী নন; বরং একজন সমব্যথী।

ডারবান টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের ২২০ রানের হার যথারীতি সমালোচনার ছিপি খুলে দিয়েছে। সেই ছিপি দিয়ে বেরিয়ে আসছে নানা প্রশ্ন—কোচ আগে ব্যাটিং করার পরামর্শ দেওয়ার পরও দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটাররা মিলে কেন আগে দক্ষিণ আফ্রিকাকেই ব্যাটিংয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন? জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়েরা কোচের কথা শোনেন না বলে পরোক্ষে টেনে আনা হলো তামিমের সঙ্গে ডমিঙ্গোর অতীত হতে চলা শীতল সম্পর্কের প্রসঙ্গও।

ডমিঙ্গোর শহরে ডারবানের লজ্জা কি কাটবে
ছবি: বিসিবি

প্রশ্নগুলো যখন খোদ বিসিবির শীর্ষ মহল থেকে ওঠে, তখন আসলে ক্রিকেটারদেরও আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। আর টসের আগে যে যেই মতামতই দিক, টস জেতার পর কী নেওয়া হবে, সেটি শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই হয়। সিদ্ধান্ত কখনো ঠিক হয়, কখনো হয় ভুল, কিন্তু যা-ই হোক না কেন, সেটির দায়দায়িত্ব পুরো টিম ম্যানেজমেন্টের ওপরই বর্তায়।

সমস্যা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিটাই এমন যে সেখানে সাফল্যের ভাগ সবার। ব্যর্থতা কেবল ক্রিকেটারদের। পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টের মাত্র দুই দিন বাকি থাকতেও তাই কিংসমিডের ক্ষতে দেওয়া হলো আরেকটা খোঁচা, যেটিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি দলের কেউই। এমনকি যার পক্ষ নিয়ে এত কথা, সেই রাসলে ডমিঙ্গোও এতে একটু অবাকই। অসময়ের এই আলোচনা দলের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর মনে হচ্ছে না তাঁর কাছে।

আর সে কারণেই তামিমের সঙ্গে তাঁর কালকের আলোচনার স্থায়িত্ব ১০ মিনিটও নয়। মতের অমিল থাকলেই না তর্কবিতর্ক দীর্ঘ হবে! আলোচনার বিষয়টা দুজনের কাছেই ‘অহেতুক’ মনে হলে অত কথার আর দরকার কী!