মুশফিককেই কেন এত পছন্দ প্রবাসীদের?
হাসারাঙ্গা ডি সিলভার বলটাকে কী দারুণ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন মুশফিকুর রহিম! ডিপ মিড উইকেটের আকাশ পার হয়ে ছক্কা। স্লগ সুইপে মুশফিক তাহলে শুধু আউটই হন না, তাতে ভালো কিছুও হয়!
এক ওভার পর হাসারাঙ্গার মতোই ঘাড় ঘুরিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে বিষণ্ন দৃষ্টি ফেলতে হলো পেসার বিনুরা ফার্নান্ডোকেও। স্লোয়ার দিয়েছিলেন বিনুরা। আবারও মুশফিকের স্লগ সুইপ এবং আবারও ছক্কা।
এক ওভারের ব্যবধানে মুশফিকের দুই ছক্কা যেন শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উৎসবের বান ডাকল! উচ্চগ্রামে ডিজের মিউজিক বাজছে। হাততালির তালে তালে ‘মুশফিক মুশফিক’, ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত চারদিক।
মাঠে বাংলাদেশের আরেকজন ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ নাঈমও তখন সমানে তলোয়ার চালিয়ে যাচ্ছেন। নাঈম তখনো ছক্কার দেখা না পেলেও শারজার গ্যালারি যে লাল–সবুজ বাংলাদেশে মাতোয়ারা হয়ে উঠল, সেটার একটা উপলক্ষ ছিল তাঁর ব্যাটিংও। কিন্তু হাততালির শব্দ ছাপিয়ে গ্যালারি থেকে বেশি ভেসে আসছিল ‘মুশফিক, মুশফিকই’।
এর সুনির্দিষ্ট কারণও আছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার নির্বাচনের ভোট হলে সন্দেহাতীতভাবেই বিপুল ভোটে জিতবেন মুশফিক। না, কোনো জরিপের ফলাফল নয় এটি। কোনো গবেষণাও হয়নি এ নিয়ে। বাংলাদেশ দলকে অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট কাভার করার অভিজ্ঞতার সৌজন্যেই এই উপলব্ধি।
অনেক দেশেই প্রবাসীদের কাছে যখন জানতে চেয়েছি, ‘বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারের খেলা আপনার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে’, বেশির ভাগ সময় উত্তর শুনেছি, ‘মুশফিক’। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেও ব্যতিক্রম কোনো অভিজ্ঞতা হচ্ছে না।
আজ যখন শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মুশফিক শটের ফল্গুধারা বইয়ে দিচ্ছিলেন, খেলা দেখতে আসা দুবাইপ্রবাসী একদল তরুণের প্রতিনিধি হয়ে চট্টগ্রামের সাইফুল তখন বলছিলেন মুশফিককে তাঁদের কেন এত পছন্দ, ‘মুশফিকের খেলাই আমাদের বেশি ভালো লাগে। তাঁর ব্যাটিংয়ের যে ধরন, ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলা ধরে ফেলতে পারেন এবং সব মিলিয়ে চমৎকার ব্যাটিং করেন। এ জন্য তাঁকে বেশি ভালো লাগে।’
সাইফুলের সঙ্গে কথা হতে হতেই মুশফিকের আরেকটি অনবদ্য শট! এবার অবশ্য ছক্কা নয়, চার। বিনুরার গুড লেংথের বলে পর্যাপ্ত জায়গা বানিয়ে কাট, পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারি।
আগের প্রসঙ্গে ফেরা যাক—মুশফিক কেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের এত পছন্দ? বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ বা কোনো তরুণ ক্রিকেটারও তা হতে পারতেন তাঁদের সবচেয়ে পছন্দের! মুশফিক কেন?
এই প্রশ্নের আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। আর মুশফিককে বেশি পছন্দ বলে অন্যদের যে পছন্দ নয়, তা তো নয়! যেদিন যে ক্রিকেটার ভালো খেলেন, দলের জয়ে ভূমিকা রাখেন, স্বাভাবিকভাবেই সেই ক্রিকেটারই হয়ে ওঠেন সবার প্রিয়তম।
তারপরও সাধারণের মনে মুশফিকের আলাদা জায়গা করে নেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত খেলাটার প্রতি তাঁর নিবেদন, ভালো করার তাড়না এবং সে জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়ার মানসিকতা। সংবাদমাধ্যমে এবং ইউটিউব–ফেসবুকের কল্যাণে এখন তো এসব কথা বিদেশেও সবাই জানে।
মুশফিক যে ছুটির দিনেও ব্যাট–প্যাডের ঝোলা কাঁধে নিয়ে একা একা মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে চলে আসেন অনুশীলন করতে, অজানা নয় সে কথাও। এই প্রবাসীরা মনে করেন মুশফিক তাঁদের কাতারের লোক। প্রবাসে তাঁরা যেমন কষ্ট করেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয়–রোজগার করেন; মুশফিককেও তাঁরা মনে করেন সে রকমই একজন। দেশের জন্য যিনি ঘামের প্রতিটি বিন্দু নিংড়ে দিতে চান।
আর মুশফিকের ম্যাচ জেতানো ইনিংসগুলো তো সব সময়ই তাঁদের চোখের সামনে জ্বলজ্বলে। বাংলাদেশে জিতলে বিদেশের মাটিতে প্রবাসীদের মাথা উঁচু হয়। কর্মস্থলে বড় মুখ করে যেতে পারেন। সেই জয়গুলো যাঁর বা যাঁদের হাত ধরে আসে, তাঁদের জন্য এই মানুষগুলোর মনে অফুরন্ত ভালোবাসা থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
লেখার এই পর্যায়ে আবারও ‘মুশফিক মুশফিক’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে শারজা স্টেডিয়ামের গ্যালারির বৃহদাংশ, যেটি পুরোই বাংলাদেশের দখলে। দুশমন্ত চামিরার করা ইনিংসের শেষ বল ছিল ওটা। উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে স্কুপ মেরে তাতে মুশফিকের আরেকটি বাউন্ডারি। দুই ছক্কা আর পাঁচ চারে ৩৭ বলে অপরাজিত ৫৭ রান নিয়ে যখন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তিনি মাঠ ছাড়ছেন, বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে ৪ উইকেটে ১৭১ রান। জয়ের সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে প্রবাসের বাংলাদেশি মুখগুলোতে।
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে সময়টা ভালো যাচ্ছিল না মুশফিকের। ২০১৯ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে ভারতকে হারানো ম্যাচে অপরাজিত ৬০ রান করেছিলেন। এর পর থেকে আজকের আগপর্যন্ত ১২ ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ ৩৮ রান করেছেন স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপেরই প্রথম ম্যাচে। এরপর ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে ৬ আর ৫। মুশফিক যেন নিজেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
অবশেষে খুঁজে পেলেন এবং সেটি হয়তো হাসারাঙ্গা বা বিনুরাকে মারা কোনো ছক্কায় অথবা গ্যালারি গর্জে তোলা ‘মুশফিক, মুশফিক’ প্রতিধ্বনি থেকেই। মুশফিকের মতো ক্রিকেটারদের ফিরে আসতে এটাই লাগে আসলে—আবহ আর আবহসংগীত। এ দুটো পেলে তাঁরা জানেন কীভাবে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে হয়।