পাকিস্তানের এই অন্ধ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ গুগলের চেয়েও দক্ষ

পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে সোহাইল খান। ছবিটি নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন এই অন্ধ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ।
ছবি: টুইটার

অপরাহ উইনফ্রে বলেছিলেন, স্বপ্নের পেছনে ছোটার চেয়ে বড় রোমাঞ্চ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ স্বপ্নের পিছু ছুটে সফল হলে সবাই পিঠ চাপড়ে দেন। সোহাইল খানের ক্ষেত্রে তাহলে কী বলা উচিত?

জীবন তাঁকে দৃষ্টিশক্তি দেয়নি। কিন্তু যে স্বপ্নের পিছু ছুটে তিনি আজ এখানে, তা চোখের আলোয় না দেখে কীভাবে সম্ভব! সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ বলতে পারেন, এ তো অসম্ভব!

জন্মগত প্রতিবন্ধকতা কিছু বিশেষ মানুষের ক্ষেত্রে প্রেরণার আধার। প্রতিবন্ধকতা জয় করার তাড়না থেকেই মানুষ হয়তো অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে। সোহাইল খান ক্রিকেট ভালোবাসেন, তিনি এই খেলার একজন সংবাদকর্মী। এটুকু পড়েই হয়তো অবাক লাগতে পারে। এবার যদি বলা হয় তিনি শুধু সংবাদকর্মীই নন, একজন দক্ষ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদও!

শতবর্ষেরও পুরোনো এ খেলার পাতার গলি, উপগলি, তস্যগলির নানা তথ্য-উপাত্ত তাঁর ঠোঁটের ডগায় থাকে। পাকিস্তানে তাঁর আরেক নাম ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ক্রিকেট’, অর্থাৎ ক্রিকেটের বিশ্বকোষ।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই অন্ধ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদকে স্বীকৃতি দিয়েছে দেশটির সিন্ধ প্রদেশের ক্রীড়া সংবাদকর্মী অ্যাসোসিয়েশন (এসজেএএস)। এ সম্মাননা প্রদানে তাদের সঙ্গে যৌথ আয়োজক হিসেবে ছিল গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয়।

সোহাইল খানকে প্রথম অন্ধ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তারা।
গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ক্রিকেট নিয়ে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অসংখ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেন সোহাইল খান। পাকিস্তানের বিভিন্ন খ্যাতিমান ক্রীড়া সংবাদকর্মী এই প্রশ্নোত্তর পর্বে বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্কোরলাইন সাময়িকীর সম্পাদক শোয়াইব আহমেদ ও ক্রীড়া সংবাদকর্মী ফাইজান লাখানি।

সোহাইল খানের গল্পটা যেকোনো স্বপ্নবাজের জন্যই প্রেরণার। চোখের আলো হারিয়েও ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসার ধরন অনেকটা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার লাইনের মতো, ‘এখনো আলো আসে/ জানালা খোলা রাখি...।’ সোহাইল খান সেই আলোর দেখা পাওয়ার গল্পই একবার জানিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি পাকিস্তান’কে।

টিভি ও রেডিওতে ক্রিকেট ধারাভাষ্য শুনে তাঁর শৈশব কেটেছে। প্রতিবন্ধকতাকে প্রেরণায় রূপান্তরিত করার রহস্যটা সোহাইল ভাঙলেন এভাবে, ‘আমি লোকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের চিনতে পারি। আপনি নিজের সব বাধা-বিপত্তিতে অভিশাপের চোখে দেখে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন কিংবা এসব পুঁজি করে নিজের প্রতিভা বের করে আনতে পারেন।’

পাকিস্তানের স্থানীয় এক রেডিও চ্যানেলে আরজে (রেডিও জকি) হিসেবে কাজ শুরু সোহাইলের। সবার সহযোগিতা, সমর্থন পান তিনি। এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় ঘটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে, এরপর কাজ করেন টিভি চ্যানেলে, ‘কখনো অসাধারণ কিছু করার লক্ষ্য ছিল না। শুধু নিজের কাজটাই করে গেছি। যতটুকু আসতে পেরেছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট।’

সোহাইলের প্রিয় ক্রিকেটার ইনজামাম-উল-হক। তাঁকে নিয়ে চমকে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য আছে কি না, জানতে চাইলে সোহাইল বলেন, ইনজামাম ক্যারিয়ারের প্রথম আটটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন আটটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে। সেসব দেশের নামও সোহাইল বলেছেন সঠিক ক্রম অনুযায়ী।

দৃষ্টিশক্তিহীন এই ক্রীড়া সংবাদকর্মীর দিন-তারিখ সঠিক ক্রম অনুযায়ী মনে রাখার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। ডেইলি পাকিস্তান জানিয়েছে, দিন-তারিখ ও বিশদ বিবরণে সোহাইলের কখনো ভুল হয় না। তাঁর বন্ধুদের ভাষ্যমতে, কখনো কখনো এমন হয়েছে যে গুগলে তথ্য খুঁজে বের করতে যতটুকু সময় লাগে সোহাইল তার চেয়েও দ্রুত সময়ে উত্তর দিয়েছেন।

সরাসরি সম্প্রচারিত ম্যাচ সোহাইলের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তবু তিনি সেসব ম্যাচের খুঁটিনাটি মনে রেখে ধারাভাষ্য দেন কীভাবে? এর উত্তরে সোহাইল জানালেন, নিজের মস্তিষ্ককে তিনি নানা কাজে দক্ষ করেছেন। পাশের ধারাভাষ্যকারের কোনো তথ্য কিংবা বিশ্লেষণকে এতটুকু নষ্ট না করে সোহাইল নিজের মতো করে ধারাভাষ্য দেন।

তাতে ম্যাচের পরিস্থিতি ঠিকঠাক উঠেও আসে। পাকিস্তানে সম্প্রতি যত ক্রিকেটার এসেছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে সোহাইলের এবং সবাই তাঁর ক্ষমতা দেখে চমকে গেছেন।