তৃতীয় ওয়ানডের আগে
প্রাণবন্ত সাকিবকেই পাচ্ছে বাংলাদেশ
কাল অনুশীলনে সাকিবকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাঁর পরিবারের ওপর দিয়ে। তাঁর দৃষ্টি এখন সিরিজ জয়ের দিকে।
কোনো এক সতীর্থ নিশ্চিত গোলটা একটুর জন্য মিস করে ফেললেন। সেটি দেখে আফসোসে সুপার স্পোর্ট পার্কের মাঝমাঠে দাঁড়ানো সাকিব আল হাসানের মাথায় হাত। এমন সুযোগও কেউ হাতছাড়া করে!
ফুটবলটা ভালোই খেলেন মেসিভক্ত সাকিব। নিজে যদিও ক্রিকেটার, অনুশীলনে গা–গরমের ফুটবলে তাঁর পায়ের শৈলী মুগ্ধ করবে যে কাউকে। কিন্তু এই সময়টা অন্য রকম। ফুটবল কেন, এখন তো তাঁর কোনো কিছুই উপভোগ করতে পারার কথা নয়!
ঢাকায় মা, শাশুড়ি আর দুই সন্তান হাসপাতালে ভর্তি। স্ত্রী এবং আরেক সন্তানও অসুস্থ। এ অবস্থায় সাকিব সিরিজের বাকি ম্যাচগুলো খেলবেন কি না, সেটি নিয়ে এক দিন আগেও ঢাকা–জোহানেসবার্গ–সেঞ্চুরিয়নজুড়ে ছিল ঘোর অনিশ্চয়তা। কিন্তু সে অনিশ্চয়তা যেন সাকিব ছাড়া অন্যদেরই স্পর্শ করেছে বেশি!
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চাইলেও সাকিবের পক্ষে অসুস্থ মা–সন্তানদের জন্য তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। এক পারতেন দেশে ফিরে যেতে। সেটি শেষ পর্যন্ত করেননি সাকিব। আর ঢাকায়ও নাকি চিন্তিত হওয়ার মতো নতুন কোনো খবর নেই। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব তাই খেলাতেই পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অনুশীলনে কাল বেশ প্রাণবন্তই মনে হলো তাঁকে। গা–গরমের ফুটবল শেষে নেট অনুশীলনের শুরুতেই সেরে ফেলেন নিজের ব্যাটিংটা।
পারিবারিক ও মানসিক পরিস্থিতি যে রকমই হোক, সাকিব সচেতনভাবেই সেসবের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখছেন দলকে। নিজের সমস্যাটা নিজের মধ্যে রেখে মিশে থাকছেন দলের সবকিছুতে। সাকিব নিজেও ভালো করেই জানেন সেঞ্চুরিয়নে আজকের ম্যাচটা দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জয়ের পর বাংলাদেশের সামনে এবার সিরিজ জয়েরও হাতছানি। তার আগে অন্তত বাহ্যিকভাবে সাকিবের চিন্তায় যেন ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই নেই।
কাল দুপুরে সুপার স্পোর্ট পার্কের মাঠে অনুশীলনের আগে নির্বাচক হাবিবুল বাশারও সে রকমই বলছিলেন, ‘সাকিবের মনের মধ্যে তো অবশ্যই একটা চিন্তা আছে, আমরা সবাই তা বুঝতে পারি। কিন্তু সেটা ও প্রকাশ করছে না। সে খুবই ইতিবাচক এবং ড্রেসিংরুমেও এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। সে ওর মতো থাকছে। দেখে ভালো লাগছে, ও যে একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।’
সাকিবের অনুজ সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজের মনে হচ্ছে জাতীয় দায়িত্বে থেকেও পরিবারের ক্রান্তিলগ্নে দৃঢ় মানসিকতারই পরিচয় দিচ্ছেন সাকিব। কাল ম্যাচপূর্ব অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রতিনিধি হয়ে আসা মিরাজ বলছিলেন, ‘আমরা জানি, সাকিব ভাই মানসিকভাবে সব সময়ই খুব দৃঢ়। তাঁর পরিবারের এই পরিস্থিতিতে আমরা সবাই তাঁকে সহযোগিতা করছি।’
এই সেঞ্চুরিয়নেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে আসা জয়টাতে দলের সবারই কিছু না কিছু অবদান ছিল। ওপেনিংয়ে তামিম ইকবাল–লিটন দাসের ভালো শুরুর পর ইয়াসির আলীর ফিফটি, পরে মাহমুদউল্লাহ–আফিফ হোসেন–মিরাজদের ছোট ছোট ইনিংস এবং বল হাতে তাসকিন আহমেদ–শরীফুল ইসলাম–মিরাজদের জ্বলে ওঠা মিলেই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ২০ বছরে প্রথম জয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ।
তবে সেই জয়ে সাকিবের ছোঁয়াটা একটু বেশি ছিল বলেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন তিনি। সাকিবের ৬৪ বলে ৭৭ রানের ইনিংসটা পুরো দলের আত্মবিশ্বাসেই ঢেলেছে সঞ্জীবনী সুধা, যেটার প্রভাব পড়েছে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায়ও। সাকিবের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের বার্তাটা ছিল পরিষ্কার—দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটেও চাইলে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলারদের শাসন করা যায়। অথচ সেদিন সাকিব ব্যাটিংয়ে নামার আগেই তাঁর মা এবং এক সন্তান হাসপাতালে, আরেক সন্তান হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সাকিব যখন ব্যাটিং করছিলেন তখন।
এ রকম মানসিক অবস্থায় দলের দিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই সাকিবের ওপর প্রত্যাশার চাপ নেই। আর সাকিবের অভিধানে তো ‘চাপ’ শব্দটা কখনো ছিলই না। দলের আর সবার মতো তাঁর দৃষ্টিটাও আজ থাকবে সিরিজ জয়ের দিকেই।