১৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে ২২ ইনিংসে পাঁচটি সেঞ্চুরি। সর্বশেষ তিন সেঞ্চুরি এসেছে সর্বশেষ ৮ ইনিংসে। ক্যারিয়ারে যে পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছেন, পাঁচটিই ভিন্ন পাঁচ দলের বিপক্ষে, ভিন্ন পাঁচ দেশে। ফাওয়াদ আলমের ফর্ম দেখে পাকিস্তান সমর্থকদের বুঝি আক্ষেপই হয়। কেন যে মাঝে ১১ বছর তাঁকে দলে ডাকল না পাকিস্তান!
আক্ষেপ আর আনন্দের যুগল অনুভূতি কাল কিংস্টন টেস্টের তৃতীয় দিনে আরেকবার ছড়িয়ে দিলেন ফাওয়াদ। তাঁর অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংসে কিংস্টনে কাল সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে শেষ পর্যন্ত ৯ উইকেটে ৩০২ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। তাতে একটা রেকর্ডও হয়েছে ফাওয়াদের। এশিয়ান ক্রিকেটারদের মধ্যে টেস্টে এত কম ইনিংস খেলে পাঁচটি সেঞ্চুরির কীর্তি গড়তে পারেননি আর কেউই!
ফাওয়াদের ঝলকের পর নতুন বল হাতে ত্রাস ছড়িয়েছেন বাঁহাতি ফাস্ট বোলার শাহীন শাহ আফ্রিদি। তাতেই বৃষ্টিবিঘ্নিত দিনটা হয়ে গেল পাকিস্তানের। শাহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনারকে ফিরিয়েছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দিন শেষ করেছে ৩ উইকেটে ৩৯ রান নিয়ে।
২০০৯ সালে অভিষেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন ফাওয়াদ। কিন্তু সে সময় তিন টেস্ট খেলার পর যে তাঁকে বাদ দিয়েছিল পাকিস্তান, ১১ বছর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি ফাওয়াদের। গত বছরের আগস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে ফেরেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, সে সময় ফাওয়াদের ৩৫তম জন্মদিনের আর মাস দু-এক বাকি!
কিন্তু ফেরার পর তৃতীয় টেস্টেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চে সেঞ্চুরি পেলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে তিন অঙ্কের দেখা পেলেন করাচিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও। এপ্রিলে সেঞ্চুরি এল হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, এরপর কাল কিংস্টনে।
সেঞ্চুরিটা এসে পাকিস্তানের জন্য দারুণ প্রয়োজনের সময়েই! বৃষ্টিবিঘ্নিত কিংস্টন টেস্টের প্রথম দিনে প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা ফাওয়াদ পায়ের পেশিতে টান পড়ার কারণে ৭৬ রানে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। কিন্তু প্রথম দিনেই বাবর আজমের (৭৫ রান) সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ১৫৮ রানের দারুণ জুটি গড়ে পাকিস্তানকে প্রথম দফায় বিপদের হাত থেকে বাঁচান। ২ রানেই ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের!
এরপর দ্বিতীয় দিনটা তো পুরোটাই বৃষ্টির দখলে চলে গেল, কাল তৃতীয় দিনে বৃষ্টি না হলেও বৃষ্টিতে মাঠের বোলিং প্রান্ত সংলগ্ন একটা অংশ স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকায় আপত্তি তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সকালে নির্ধারিত সময়ের ৯০ মিনিট পর খেলা শুরু হলেও ৮ বল হতেই মাঠ নিয়ে আপত্তি জানান ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলরাউন্ডার জেসন হোল্ডার। সেটি ঠিক করে খেলা শুরু হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়!
খেলা যখন শুরু হলো, ৪ উইকেটে ২১২ রান নিয়ে দিন শুরু করা পাকিস্তান ইনিংসে ৬ রান যোগ করতেই হারায় ফাহিম আশরাফকে। ২৩ রান নিয়ে দিন শুরু করেছিলেন, আর ৩ রান যোগ করেই জেইডেন সিলসের বলে এলবিডব্লু হয়ে ফেরেন আশরাফ। এরপরই মাঠে নামেন ফাওয়াদ এবং এরপর থেকে পাকিস্তানের ইনিংসে ৩০০ পেরোনোর সব আশা ভরসার কেন্দ্রে ছিলেন তিনিই!
২২ রান নিয়ে দিন শুরু করা মোহাম্মদ রিজওয়ান ৩১ রানে হোল্ডারের বলে এলবিডব্লু হয়ে ফিরলেন, তার পরের বলেই হোল্ডার ফেরান নোমান আলীকেও। পাকিস্তান তখন ৭ উইকেটে ২৩১! সেখান থেকে হাসান আলী (৯) ও শাহীন আফ্রিদির (১৯) সঙ্গে যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৫ রানের দুই জুটিতে পাকিস্তানকে ৩০০ পার করান ফাওয়াদ। মাঝে হাসান আলী রানআউট হয়েছেন ফাওয়াদের ভুলেই, কিন্তু ছয় ঘণ্টায় ২১৩ বলে ১৭ চারে সাজানো ইনিংসে ফাওয়াদ প্রতিটি মুহূর্তেই যেন চোয়ালবদ্ধ ছিলেন পাকিস্তানকে ভালো একটা স্কোরে নিয়ে যেতে। যে সংকল্পের পুরস্কার হয়ে এল সেঞ্চুরিও। কাইল মায়ার্সের বলে পুল করে দুই রানে সেঞ্চুরিতে যখন পৌঁছেছেন, ততক্ষণে ১৮৬ বল খেলে ফেলেছেন ফাওয়াদ।
‘দেশের হয়ে সেঞ্চুরি করতে পারলে সব সময়ই গর্ব হয়, আমি এই মুহূর্তে অনেক খুশি। আমার বাবা সব সময় আমার প্রেরণা হয়ে ছিলেন। সব সময় বলতেন চেষ্টা চালিয়ে যেতে, বলতেন আমার সময় একদিন আসবে, এখন সে সময়টা এসেছে এবং আমি সেটাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে চাই’—দিন শেষে বললেন তৃপ্ত ফাওয়াদ। নিজের ইনিংসে ফিরে তাকিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ, ‘ব্যাট করাটা কঠিন ছিল এখানে। প্রথম দিনে বাবর আর আমি মিলে যা করেছি, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে কেমার রোচ ও জেইডেন সিলস তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন। তবে রোচ প্রথম দিনে পাকিস্তানের ইনিংসে যে ধাক্কা দিয়েছিলেন, কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে শেষ বিকেলে সেরকম ধাক্কা দিয়েছেন শাহীন আফ্রিদি। নতুন বলে পরপর দুই ওভারে ফিরিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনার কাইরন পাওয়েল (৫) ও ক্রেইগ ব্রাফেটকে (৪)। এর মধ্যে যে চোখধাঁধানো ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কারে বোল্ড করেছেন পাওয়েলকে, তা দেখে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করা ওয়াকার ইউনিসের হয়তো নিজের খেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে!
এরপর ফাহিম আশরাফ এসে বোল্ড করেছেন রোস্টন চেজকে (১০)। ১৪তম ওভারেই ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামায় আলজারি জোসেফকে। দিন শেষে তিনি ০ রানে অপরাজিত ছিলেন, অন্য প্রান্তে ১৮ রানে অপরাজিত তিনে নামা এনক্রুমা বোনার।
কিংস্টনেই সিরিজের প্রথম টেস্টে নাটকীয়ভাবে ১ উইকেটে জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।