তাঁর বয়স টেস্ট ক্রিকেটের সমান। চিরদিন তা-ই থাকবে। পার্থক্য হলো, টেস্ট ক্রিকেট এখনো ‘জীবিত’ আর উইলফ্রেড রোডস ৪২ বছর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
আফসোসের কিছু নেই। ৯৫ বছর ২৫২ দিন বয়সে কারও মৃত্যু হলে আফসোসের কিছু থাকেও না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর ৫৮টি সেঞ্চুরি, টেস্ট ক্রিকেটে ২টি, জীবনের ইনিংসেও তো ‘সেঞ্চুরি’ প্রায় করেই ফেলেছিলেন।
ক্রিকেটের অমর বুড়ো বললে সবাই দাড়িওয়ালা ওই ডাক্তারের কথাই ভেবে বসেন। তবে ডব্লু জি গ্রেস নন, ক্রিকেটে ‘বুড়ো’-বিষয়ক কথাবার্তায় উইলফ্রেড রোডসের নামটাই সবার আগে আসা উচিত। গ্রেসের চেয়ে ২৮ বছরেরও বেশি আয়ুষ্কাল একটা কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ, টেস্ট ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে ‘বুড়ো বয়সে’ শিরোনামে যে পাতাটা, সেখানে উইলফ্রেড রোডসের নামটাই সবচেয়ে জ্বলজ্বলে।
কেন, সেটি বলার আগে একটা প্রশ্ন করি—৫২ বছর বয়সে আপনি কী কী করতে চান বা করা সম্ভব বলে মনে করেন? একেক জনের উত্তর একেক রকম হবে স্বাভাবিক, তবে কারও উত্তরেই ‘টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চাই’ থাকার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। ৫২ বছর বয়সে কি আর টেস্ট খেলা যায় নাকি!
যায়, ৫২ বছর ১৬৫ দিন বয়সেও টেস্ট খেলতে নেমে পড়া যায়। উইলফ্রেড রোডস তাঁর ৫৮ টেস্টের সর্বশেষটি খেলতে নেমেছিলেন ওই বুড়ো বয়সেই। খুব খারাপও করেননি। ব্যাটিংয়ে দুই ইনিংসেই অপরাজিত। রান অবশ্য বেশি করেননি—৮ ও ১১। ১০ নম্বরে নেমেছিলেন, ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে তিনি কি-ই বা করতে পারেন!
বোলিংয়ে দুই ইনিংসে ১টি করে উইকেট। কিন্তু ওই বুড়োর বলেই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানরা কেমন হাঁসফাঁস করেছেন, বোলিং ফিগারেই এর প্রমাণ। দুই ইনিংসেই ওভারের চেয়ে রান কম! প্রথম ইনিংসে ২০.৫ ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ১৭ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪ ওভারে ২২।
এসব পরিসংখ্যান অবশ্য বলার জন্যই বলা। কিছু না করতে পারলেই বা কী হতো, খেলতে নেমেই তো আসল কীর্তিটা করে ফেলেছেন রোডস। টেস্ট ক্রিকেটে অবিনশ্বর রেকর্ড হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে দুটির কথা মনে পড়ছে—ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় ও জিম লেকারের এক টেস্টে ১৯ উইকেট। সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলার রেকর্ডটিকেও এর সঙ্গে যোগ করে নিন। এই রেকর্ডটির কারণেই রোডস ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, অমর হয়েই থাকবেন।
শুধু এই রেকর্ডটির কারণেই? ভুল বলা হলো। রোডসের অমরত্ব শুধু বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলেন বলেই নয়। অমর হয়ে আছেন তিনি ক্রিকেটীয় কীর্তিতেও। ১৮৯৯ সালে প্রথম টেস্ট খেলেছেন, ১৯৩০ সালে শেষ। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার আরও এক বছর বেশি লম্বা। হিসাব করে ফেলুন, বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে যাবে—৩২ বছরের ক্যারিয়ার!
টেস্টে ২টি সেঞ্চুরিসহ ২ হাজার ৩২৫ রান, বাঁহাতি স্পিনে উইকেট ১২৭টি। শুধুই একজন স্পিনার থেকে অলরাউন্ডার হয়ে ওঠার গল্পটাও চমকপ্রদ। ১১ নম্বরে ব্যাটিং শুরু করে জ্যাক হবসের ওপেনিং পার্টনার হয়েছেন। ব্যাটিং করেছেন ১ থেকে ১১ সব পজিশনেই। আর মাত্র দুজনেরই আছে এই ‘অর্জন’ (অস্ট্রেলিয়ার সিড গ্রেগরি ও ভারতের ভিনু মানকড়)।
উইলফ্রেড রোডসের আসল মহিমা বুঝতে অবশ্য তাকাতে হবে তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের দিকে। ৪০ হাজার ছুঁই ছুঁই রান, সঙ্গে ৪,২০৪ উইকেট। উইকেট-সংখ্যা এখনো রেকর্ড। আর কোনো বোলারের চার হাজার উইকেটও নেই। সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলার মতো রোডসের এই রেকর্ডটাও আসলে অমরত্ব পেয়ে গেছে।
রোডসের শেষ টেস্টের কথা বলছিলাম। কিংস্টনে ওই টেস্টটি বিখ্যাত হয়ে আছে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি দর্শনের কারণে। প্রথম ইনিংসে ইংলিশ ওপেনার অ্যান্ডি স্যান্ডহামের ওই ৩২৫। হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসেও। তারপরও সেটিই কেন স্যান্ডহামের শেষ টেস্ট হয়ে গেল, এ এক রহস্য বটে।
ওই ম্যাচের ইংল্যান্ড দলে রোডস ছাড়াও বয়সের হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেলা আরেকজন ছিলেন। টেস্ট শুরুর দিন জর্জ গানের বয়স ছিল ৫০ বছর ৩০৩ দিন। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে দুই বুড়ো মিলে আউট করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনার ক্লিফোর্ড রোচকে (ক গান ব রোডস)। টেস্ট ক্রিকেটে রোডসের শেষ উইকেটটিতে বোলার-ফিল্ডারের মিলিত বয়স ১০৩ বছর—অবিনশ্বর রেকর্ডের তালিকায় এটাও যোগ করে নেওয়া যায়।
দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে শেষ বয়সে একেবারে অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন রোডস। তারপরও নিয়মিতই ক্রিকেট মাঠে যেতেন। ব্যাটে বল লাগার আওয়াজ শুনেই নাকি বলে দিতে পারতেন, শটটা কেমন হলো!
আপনার মনে যে প্রশ্নটা জাগছে, সেটি অনুমান করতে পারছি। হঠাৎ করে উইলফ্রেড রোডসকে নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ তো আছেই। আজ উইলফ্রেড রোডসের জন্মবার্ষিকী। কততম? সেটি তো আপনিই বের করে নিতে পারেন। শুরুতেই লিখলাম না, টেস্ট ক্রিকেট আর উইলফ্রেড রোডসের বয়স সমান।
শুভ জন্মদিন, উইলফ্রেড রোডস!