সম্রাট–আকবর দুই ভাই। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ছনপাড়ায় তাঁদের বাস। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ঠিকানাটার নাম ব্লুম অ্যাগ্রো ফার্ম।
কোরবানি এসে গেছে। একই মায়ের দুই সন্তান সম্রাট ও আকবরকে তাই বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা। এই ফার্মের সঙ্গে অনেকটা শখের বশেই জড়িয়ে আছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। তাঁর মুঠোফোনে সেভ করা আছে সম্রাট ও আকবরের ছবি। প্রতিটির ওজন প্রায় সাড়ে সাত শ কেজি। গরু দুটিকে দেখলে কেনার লোভ হবে যে কারোই।
খেলার মধ্যে থাকায় সম্রাট আর আকবরকে নিয়ে বেশি ভাবার সময় পাচ্ছেন না সাকিব। এটা তাঁর ভাবার বিষয়ও নয় অবশ্য। ফার্ম পরিচালনার সঙ্গে তো তিনি আর সরাসরি সম্পৃক্ত নন। তবে কোরবানির মৌসুম যেহেতু, এই সময়ে বাংলার মুঠোফোনে–মুঠোফোনে সম্রাট, আকবর, শাকিব খান, মেসিদের ঘুরে বেড়ানোই স্বাভাবিক।
জিম্বাবুয়েতে সে রকম ছবি যেমন সাকিবের মুঠোফোনে আছে, আছে বাংলাদেশ দলের অন্যদের মুঠোফোনেও। দেশ থেকে গরু–ছাগল কিনে পরিবারের সদস্যরা ছবি পাঠাচ্ছেন। সেই ছবি দেখে খেলোয়াড়েরা জানতে চাচ্ছেন, ‘দাম কেমন পড়ল? কোন বাজার থেকে কেনা...?’
জিম্বাবুয়ে এলে অবশ্য কোরবানির মৌসুম ছাড়াও আপনাকে বেশিরভাগ সময় গরু ভক্ষণ করেই থাকতে হবে। এই দেশে মাছ দুষ্প্রাপ্য। ভেজিটেবলের বাইরে খাওয়ার মধ্যে আছে চিকেন, বিফ আর হ্যাম। শেষেরটি খাওয়া যেহেতু ইসলাম ধর্মেই নিষিদ্ধ, দুই বেলা ভেজিটেবলের সঙ্গে শুধু চিকেন আর বিফই চালাও।
চিকেন, বিফের মধ্যে বিফটাই এখানে একটু বেশি সুস্বাদু বলে ঘুরেফিরে সেদিকেই ঝুঁকে যায় সবাই। আর বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তো গরুর মাংসের জনপ্রিয়তা আগে থেকেই। শুধু তামিম ইকবালেরই চিকেনটা একটু বেশি পছন্দ।
জিম্বাবুয়ের হোটেল–রেস্তোরাঁগুলোতেও গরুর মাংসের নানা পদ। বেশি জনপ্রিয় সাদজা অ্যান্ড বিফ স্ট্যু, বিফ স্টেক ও বিফ পাই। সাদজা মূলত ভুট্টা দিয়ে তৈরি মাখামাখা একটা খাবার। এর সঙ্গে পরিবেশন করা বিফ স্ট্যু অনেকটা বাংলাদেশের গরুর ভুনার মতোই। তবে রেসিপি অবশ্যই ভিন্ন। বিফ স্টেকের কথা যদি বলেন, এখানকার কিছু রেস্টুরেন্ট চলেই মূলত তাদের বিফ স্টেকের জনপ্রিয়তার কারণে।
আর যদি শুকনো গরুর মাংস খেতে চান, তাহলে আছে বিফ বিলটং। সোজা বাংলায় বললে গরুর মাংসের শুঁটকি। কাঁচা মাংসে নানা রকম মসলা মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে তারপর তৈরি হয় এই জিনিস। খেতে যে খুব খারাপ তা নয়, তবে অনেকক্ষণ ধরে চিবোতে হবে, এই আর কি!
হারারের সুপারশপ এবং ছোটখাটো দোকানগুলোতেও সুদৃশ্য প্যাকেটে ঝুলতে দেখা বিফ বিলটং। এখানকার এএফপির ফটোগ্রাফার জেকেসাই এনজিকিজানা অবশ্য জানালেন গরুর মাংসের বিলটংয়ের চেয়ে জিম্বাবুয়েতে নাকি হাতি, জিরাফের মতো বন্য প্রাণীর বিলটং অপেক্ষাকৃত সস্তা। সেগুলোই মানুষ বেশি খায়। তবে গরুর মাংসেরটা বেশি মজার।
জিম্বাবুয়েতে গবাদিপশুর খামারের ব্যবসা মোটামুটি জমজমাটই ছিল। কিছুদিন আগেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোসহ আশপাশের দেশে রপ্তানি হতো এখানকার গরুর মাংস। কিন্তু গবাদিপশুর নানা রকম অসুখ–বিসুখের কারণে এখন রপ্তানি নেই বললেই চলে। আর মুরগি ও শূকরের মাংসের দাম অপেক্ষাকৃত সস্তা বলেও গরু–ছাগল–ভেড়ার ব্যবসা কিছুটা হুমকির মুখে।
স্থানীয় বাজারে এক কেজি মুরগির মাংসের দাম তিন থেকে সাড়ে তিন মার্কিন ডলার। গরুর মাংসের দাম পড়ে প্রায় ছয় ডলার। তবে মাংসের ধরন এবং বাজারভেদে দাম কিছুটা এদিক–সেদিক হতে পারে।
মুঠোফোনে আজ এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল জিম্বাবুয়ের কমার্শিয়াল ফার্মার্স ইউনিয়নের পরিচালক বেন গিলপিনের সঙ্গে। তাঁর অল্প কথার মধ্যেই ফুটে উঠেছে এই দেশের পড়তি গো–বাণিজ্যের ইঙ্গিত, ‘একসময় জিম্বাবুয়ে থেকে বেশ ভালো পরিমাণ গরুর মাংস বিদেশে রপ্তানি হতো। নানা প্রতিকূলতার কারণে এখন সেটা কমে গেছে। একে তো নানা অসুখ–বিসুখ আছে, এর ওপর ফার্ম চালানোর খরচও অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে গরুর মাংসের চাহিদা এখনো অনেক, তবে বিদেশের সঙ্গে ব্যবসাটা কমে গেছে।’
বাংলাদেশের মতো কোরবানির বাজারে মেসি–শাকিব খানদের দাপট এখানে নেই। তবে জিম্বাবুয়েতেও আছে হরেক রকমের গরু। স্থানীয় ম্যাসোনা অধিবাসীদের লালন–পালন করা ম্যাসোনা গরুর চাহিদাই বেশি। এ ছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে ব্রিটিশ ও ভারতীয় কিছু প্রজাতির গরুও আছে।
গরু–ছাগল–ভেড়া যে এই দেশে শুধু খাবারের মেন্যুই সমৃদ্ধ করে তা নয়, বড় বড় ফার্মের বাইরে ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে বাড়িতে গবাদিপশু পালন করেন। উদ্দেশ্যটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মতোই। বাড়িতে কিছুদিন পেলে বড় করে বেশি দামে বিক্রি করা। স্বাভাবিক সময়ে হারারে ও আশপাশের এলাকায় ১০–১২ কেজি ওজনের একটা ছাগলের দাম ৩০–৪০ মার্কিন ডলার। কিন্তু কোরবানির ঈদের সময় নাকি সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০–৮০ ডলারে!
বাংলাদেশের মানুষ এখানে আগের তুলনায় কিছুটা কম এখন। হারারের মুসলমানদের মধ্যে মূলত পাকিস্তান, ভারত ও স্থানীয়রাই বেশি। এখানকার কোরবানির বাজার তাদের অপেক্ষায় থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সাদ সে রকমই একজন। পাকিস্তান থেকে ২২ বছর আগে হারারে এসে এখন এখানেই পরিবার নিয়ে থিতু। ২০১৩ সালের সফরে বাংলাদেশ দলের লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাদের পরিচয় তখন থেকেই।
কথা প্রসঙ্গে তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল হারারের কোরবানির হালচাল। যার সারমর্ম, হারারেতে গরুর বাজার বলতে তেমন কিছুই নেই। অল্প কিছু এলাকায় ছাগল ও ভেড়া বিক্রি হয়। সেগুলো আকারে খুবই ছোট এবং দামও বেশি বলে কোরবানির পশু কিনতে মানুষ চলে যায় শহরের আশপাশের গ্রামাঞ্চলে। এরপর ঈদের দিন নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে কোরবানি দিয়ে আসে। পশু জবাইয়ের জন্য এখানে জায়গা আলাদা করা আছে। বাড়ির সামনে গরু নিয়ে জবাই করে দেবেন, এরপর মাটিতে পড়ে থাকা রক্ত ধোবেন কি ধোবেন না; এখানে তা হবে না।
করোনার কারণে এবার অবশ্য সাদের পরিবার কোরবানির দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে পরিচিত এক লোককে। তাদের হয়ে কোরবানি দিয়ে তিনি মাংস গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। লকডাউন চলায় হবে না ঈদের জামাতও। শহরে বেশ কয়েকটি বড় বড় মসজিদ থাকলেও মুসলমানরা যার যার মতো বাড়িতেই নামাজ পড়বেন।
বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের ঈদের জামাতও সম্ভবত নিজেদের মধ্যে ক্রেস্টা লজ হোটেল চত্বরেই হয়ে যাবে। তবে হারারেতে এখন পর্যন্ত যে জামাতটির কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সেটি হবে ব্রন্টে গার্ডেন হোটেলে। ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিক ও টেলিভিশন সম্প্রচারকারীদের ঠিকানা এটাই। জামাত সকাল সাড়ে আটটায়। নামাজ পড়াবেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান।