মাশরাফি-রাসেলদের ওপর ঝড় তুলে লেন্ডল সিমন্স যখন এবারের বিপিএলের প্রথম শতক তুলে নিলেন, তামিম ইকবাল মনে মনে তখন কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন কি না, শুধু তিনিই জানেন। ইনিংসের তৃতীয় বলে কোনো রান করার আগেই ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যাওয়ার পর ইনিংস নিয়ে পরিকল্পনায় কোনো বদল এনেছেন কি না, তা-ও শুধু তামিমেরই জানা।
কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে এখন কে মাথা ঘামায়! বিপিএলের অনুরাগী, মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকার সমর্থক আর তামিম ইকবালের ভক্তদের জন্য চট্টগ্রামে আজ সন্ধ্যাটা দারুণ কিছুই উপহার দিয়ে গেল। উপহার দিয়ে গেল তামিম ইকবালের শতক।
বিপিএলে তাঁর দল মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকা হতে পারে, কিন্তু তামিম তো চট্টগ্রামেরই ছেলে। চট্টগ্রামের মাটিতে আজ তাঁর চোখের সামনে সিমন্সের ‘দাদাগিরি’ যেন সহ্য হচ্ছিল না বাংলাদেশের বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের। সিমন্সের শতক ভুলিয়ে দিলেন ৬৪ বলে অপরাজিত ১১১ রানের চোখধাঁধানো ইনিংসে।
তামিমের অনবদ্য শতকে ভর করেই সিলেট সানরাইজার্সের ১৭৬ রানের লক্ষ্য ৯ উইকেট ও ১৮ বল হাতে রেখে অনায়াসেই পেরিয়ে গেল মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকা।
মোহাম্মদ মিঠুন এখন বুঝি নিজেকে শাপ-শাপান্ত করছেন! তাসকিন আহমেদের করা ইনিংসের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে স্লিপে ক্যাচ উঠেছিল তামিমের ব্যাটে লেগে, কিন্তু বাঁদিকে ঝাঁপিয়েও ক্যাচটা ধরতে পারেননি মিঠুন। তামিম ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন, সে শঙ্কা তখন সিলেটের ফ্র্যাঞ্চাইজির অনেকেরই হয়তো হয়েছে। ওভারের পঞ্চম বলে চার মেরে শঙ্কাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তামিম। কিন্তু এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবেন ঢাকার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, কে অনুমান করেছিল!
তৃতীয় ওভারে আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় বলে ক্লাসিক কাভার ড্রাইভে এল তামিমের ইনিংসের দ্বিতীয় চার, পরের বলেই আবার চার পয়েন্টে। এক বল পর দারুণ পুল শটে ছক্কা! তামিম বুঝিয়ে দিলেন তাঁর আগ্রাসন, মিঠুন আর সিলেটের সবাই তখন প্রমাদ গুনছেন!
পাওয়ার প্লে-র পরের তিন ওভারের গল্পই শুনুন। চতুর্থ ওভারে সানজামুলকে এক চার ও বিশাল এক ছক্কা, পরের ওভারে তাসকিনের বলেও এক চার এক ছক্কা, ষষ্ঠ ওভারে মোসাদ্দেকের বলে ৩ চার।
এর মধ্যে দ্বিতীয় চারেই তামিমের অর্ধশতক হয়ে গেছে! টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ৪৩তম অর্ধশতকে পৌঁছাতে মাত্র ২৮ বল লেগেছে তামিমের, সে পথে চার মেরেছেন ৭টি, ছক্কা ৩টি। এতটা ভয়ংকর তামিমকে শেষ কবে দেখা গেছে, সে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাংলাদেশের হয়ে আরও ৬ মাস টি-টোয়েন্টি খেলবেন না বলে গতকাল জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আফসোস এই ইনিংস দেখে আরও বেড়েছে নিশ্চিত।
ইনিংস যত গড়িয়েছে, আফসোস তত বেড়েছে। ৫০ থেকে ৮০-র পথে আর ছক্কা মারেননি তামিম, কিন্তু চারের বান ছুটেছেই। বোপারাকে টানা দুই চার মারলেন, তো সোহাগ গাজীকে কাট করে বাউন্ডারিছাড়া করেছেন। এর মধ্যে অবশ্য আরেকবার তাঁর ক্যাচ হাতছাড়া হলো। মুক্তার আলীর বলে শর্ট ফাইন লেগে তামিমের সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন আলাউদ্দিন, উল্টো তাতে চারও হয়ে গেল। তামিমের রান তখন ৪১ বলে ৭৫, ঢাকার রান ১০ ওভারে বিনা উইকেটে ১১৫।
সানজামুলের করা ১৪তম ওভারে দুই চার মেরে নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছানোর পর অবশ্য একটু গতি কমেছে তামিমের ইনিংসে। ওই দুই চারে ৫৩ বলে ৯৪ রান হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল, বলের হিসাবেও লেন্ডল সিমন্সের ৫৯ বলে শতককে ছাড়িয়ে যাবেন তামিম। কিন্তু ১৭তম ওভারের তৃতীয় বলে আলাউদ্দিনের বলে লং অফে চার মেরে যখন শতকে পৌঁছালেন তামিম, ইনিংসের বয়স হয়ে গেছে ৬১ বল।
তা বলের হিসাবে না হলেই বা কী! এমন তো নয় যে ৫৯ বলের কমে শতক হলে কোনো বিশ্বরেকর্ড হয়ে যেত! সিমন্সকে বলের হিসাবে না ছাপিয়ে গেলেও চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার ‘স্কেলে’ তামিমই এগিয়ে। ৫১ থেকে ১০০, অর্থাৎ ইনিংসের দ্বিতীয় পঞ্চাশের তামিম চার মেরেছেন ৯টি, ছক্কা একটিও নয়। তবে ছক্কার আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়েছেন শতকের পরের বলেই, আলাউদ্দিনকে লং অফে বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলে। ১৭তম ওভারের প্রথম বলে তামিমের ইনিংসের ১৭তম চারেই এসেছে ঢাকার জয়।
তামিমের শতকের কারণে ঢাকার আরেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ শেহজাদের ইনিংসটা আড়ালেই চলে গেছে। তামিমকে কী দারুণ সঙ্গতই না দিয়েছেন আফগান উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান! ৩৯ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় করেছেন ৫৩ রান। ১৭তম ওভারের পঞ্চম বলে তিনি যখন আলাউদ্দিনের বলে সানজামুলের ক্যাচ হয়ে ফিরছেন, ঢাকার রান ততক্ষণেই ১৭৩! জয় পেতে আর দুই রান দরকার ছিল, পরের ওভারের প্রথম বলে তামিমের চার সমীকরণটা মিলিয়ে দিল।