হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছিল ওয়ার্নের নানারও

মা–বাবার সঙ্গে শেন ওয়ার্ন। এ ছবি এখন শুধুই স্মৃতিছবি: টুইটার

‘আচমকা, হার্ট অ্যাটাকে একদিন মারা গেলেন তিনি।’

কথাটা শেন ওয়ার্নকে নিয়ে লেখা, এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

থাইল্যান্ডে ছুটি কাটাতে যাওয়া শেন ওয়ার্নকে গতকাল কোহ সামুইয়ের বিলাসবহুল সামুজানা ভিলার রুমে নিথর অবস্থায় খুঁজে পেয়েছেন তাঁর সহকারী অ্যান্ড্রু নিওফিতু। প্রাথমিকভাবে তাঁর মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

দ্রুত থাই আন্তর্জাতিক হাসপাতালে নেওয়া হলেও ফেরানো সম্ভব হয়নি তাঁকে। স্থানীয় আরেকটি হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে তাঁর। তবে কর্তৃপক্ষ কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে না। তাই মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বলেই মেনে নিচ্ছেন সবাই।

কিন্তু ওপরের কথাটি স্বয়ং ওয়ার্ন লিখেছেন, তা-ও আজ থেকে চার বছর আগে। তাঁর নানা জোয়ির মৃত্যুর খবরটা এভাবেই নিজের আত্মজীবনীতে দিয়েছিলেন শেন কিথ ওয়ার্ন।

আত্মজীবনীতে মায়ের কথা বলতে গিয়ে নানার সম্পর্কেও লিখতে বাধ্য হয়েছেন। শেন ওয়ার্নের সাফল্য ও লাগামছাড়া জীবনের প্রেক্ষাপট বুঝতে তাঁর নানার জীবনের গল্প একটু হলেও সাহায্য করে। ‘নো স্পিন’ বইয়ে এভাবেই আবির্ভাব হয়েছিল তাঁর নানার, ‘যুদ্ধের ঠিক পরে, ১৯৪৬ সালে জার্মানিতে আমার মায়ের জন্ম।

শেন ওয়ার্নের আত্মজীবনীর প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

তাঁর বাবা একজন পোলিশ শরণার্থী, যিনি কিশোর বয়সেই জার্মানিতে এসেছিলেন। মায়ের দাদার বাড়ির বাঁধাকপির খামারে হাজির হয়েছিলেন ওই বয়সে। তাঁর নাম ছিল জোয়ি, ভেসেলবুরেন খামারের পাশে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন। সেখানেই লোতের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। দুজন বিয়ে করলেন এবং তাঁদের প্রথম সন্তান, আমার মা ব্রিজিটের জন্ম সেখানেই।’

জার্মানি ও পোল্যান্ডে শিকড় যাঁদের, সে পরিবারের একজন কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বা ক্রিকেট দুনিয়াতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন, সেটা জানতে আবার বইয়ে ডুব দিতে হচ্ছে, ‘আমার নানা জোয়ি, নানি লোতে, মা ও তাঁর বোন রেজিনা এভাবে শরণার্থী হয়ে বাঁধাকপি খামারে কাজ করতে করতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকে তাই রোমে। আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রগামী একটি জাহাজে উঠে পড়ার। কিন্তু তাঁদের আরও দক্ষিণে নেপলসে যেতে হয়েছে। সেখানে তাঁরা একটা জাহাজ খুঁজে পেলেন ঠিকই, কিন্তু ভুল জাহাজ। যে কারণে সবাই পাড়ি জমালেন অস্ট্রেলিয়ায়। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল এবং মাসের পর মাস অপেক্ষায় না থেকে তাঁরা অস্ট্রেলিয়াতেই আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমাদের এতে কোনো আপত্তি তোলার প্রশ্নই নেই, আমাদের পরিবারের জন্য অস্ট্রেলিয়া অসাধারণ একটা জায়গা। এটা না হলে তো আমি খুব সাধারণ বেসবল খেলোয়াড় হতাম (যুক্তরাষ্ট্রে জন্মালে)।’

অনেকেই মনে করেন, শেন ওয়ার্নের মতো ক্রিকেটার আর কখনো আসবে না
ফাইল ছবি: এএফপি

মা ও নানার সেই অস্ট্রেলিয়া-যাত্রার প্রমাণ রেখে দিয়েছেন ওয়ার্নের বাবা, ‘বাবার কাছে ওই জাহাজ, এসএস ক্যাসল বিয়ানকোর একটি নিবন্ধন তালিকা আছে। সেখানে ১৯৪৯ সালের ২৯ নভেম্বর পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলোর হাজার হাজার যাত্রীর নেপলস থেকে যাত্রা করে ২৯ ডিসেম্বরে জিলংয়ে পৌঁছানোর প্রমাণ আছে এবং সেখানে আছে একটি পরিবারের সদস্যদের নাম, যাঁরা আমাকে বড় করে তুলেছেন: ভ্লাদিস্লাভ শেপিয়াক, লোতে শেপিয়াক, রেজিনা শেপিয়াক ও ব্রিজিট শেপিয়াক।’

ভ্লাদিস্লাভ বা জোয়ির ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতার প্রমাণও দিয়েছেন ওয়ার্ন, ‘জিলংয়ে একটা লাইম কারখানায় চাকরি জোগাড় করে নিয়েছিলেন জোয়ি। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের শত শত কিলোমিটার দূরে বোনজিলা সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছয় মাস পরিবারের দেখা না পেয়ে কাটান জোয়ি। যখন পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটি চেয়েছিলেন, তারা বলেছিল, চলে গেলে তোমার চাকরি থাকবে না। তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন এবং বোনজিলা গিয়ে পরিবার নিয়ে জিলংয়ে নিয়ে এলেন। কীভাবে তাঁদের খুঁজে পেয়েছেন জানি না, তিনি ইংরেজি একবিন্দুও পারতেন না।’

শেন ওয়ার্নের ভাই জ্যাসন (সবার সামনে)
ছবি: টুইটার

কড়া শাসনের জোয়ি ও ওয়ার্নের বাবা কিথের মধ্যে সম্পর্ক অতটা ভালো ছিল না। কিন্তু শেন ওয়ার্ন ও তাঁর ভাই জেসনের জন্য মমতা ছিল জোয়ির। নিজের পরিশ্রমে ৫৫০ একর জমির একটি খামার গড়েছিলেন। শেন ও জেসনকে সেই খামারে ঘুরে দেখাতেন। রুলস ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতেন নাতিদের সঙ্গে।

তবে বাইরের মানুষের কাছে ভীষণ রগচটা এক জোয়ির দর্শনই মিলত, ‘বাবা জোয়িকে উগ্র মেজাজের কঠিন লোক ভাবতেন। দুধ দোহানোর সময় কোনো গরু ময়লা করলেই মেরে শুইয়ে ফেলতেন। মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার কিন্তু বেশ শক্তিশালী ছিলেন।

ট্যাংকের মতো গাঁট্টাগোট্টা। আমরা জানি তিনি ভালো খামারি ছিলেন। কারণ, অ্যাপোলো বের একটি ম্যাগাজিনে তাঁর ছবি প্রচ্ছদে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে চাষের অযোগ্য এক জমিতে তাঁকে চাষ করতে দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল চাঁদের জমি। এটা খুব বিপজ্জনক কাজ। লাঙলটা পাথরে লাগলেই ছিটকে বেরোত এবং আর তাহলেই আপনার খাঁড়িতে চলে যাওয়া কেউ আটকাতে পারত না। আমার বাবার সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার।’

মেলবোর্নে ওয়ার্নের ভাস্কর্যে বলের গায়ে ধন্যবাদ লিখে শ্রদ্ধা জানান এক ভক্ত
ছবি: মেইল অনলাইন

এমন এক ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের বিদায়ের বর্ণনাটাই চমকে দিতে বাধ্য, ‘আচমকা, আশি দশকের শুরুর দিকে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি। একদম মরেই গেলেন। এর তিন বছর পর আমার নানিও মারা গেলেন। দুজনের বয়সই মধ্য পঞ্চাশের আশপাশে ছিল।’

গতকাল ৫২ বছর বয়সী শেন ওয়ার্নও আচমকাই চলে গেলেন। ঠিক নানার মতো ৫০ পেরোতেই হার্ট অ্যাটাক করে।