‘মোমেন্টাম’–এর আক্ষরিক বাংলা প্রতিশব্দ ‘ভরবেগ’। তবে ক্রিকেটে যে অর্থে কথাটার খুব নিয়মিত ব্যবহার, ‘ভরবেগ’ দিয়ে তা একটুও বোঝানো যায় না। ‘আমরা মোমেন্টাম পেয়ে গেছি’, ‘আমাদের মোমেন্টামটা ধরে রাখতে হবে’—ক্রিকেটারদের মুখে আকছার শুনতে পাওয়া কথাগুলোতে ‘মোমেন্টাম’–এর বদলে ‘ভরবেগ’ বসিয়ে পড়ে দেখুন না...রীতিমতো হাস্যকর লাগবে।
তা এই মোমেন্টাম বা ভরবেগ জিনিসটা কী? যেসব সংজ্ঞা খুঁজে পেলাম, তার মধ্যে যেটি সবচেয়ে পছন্দ হলো, তা এ রকম: যে শক্তি একটা ঘটনা শুরু হওয়ার পর একে উন্নয়নশীল বা বিকাশমান রাখে, তাকে ভরবেগ বলা হয়।
আপনার একটু কুঁচকে যাওয়া ভুরু মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি, অনুমান করতে পারছি মনে জেগে ওঠা প্রশ্নটাও। এটা কি ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে লেখা, নাকি পদার্থবিজ্ঞানের কোনো ক্লাস?
ক্রিকেট নিয়ে লেখাই, তবে পদার্থবিজ্ঞানের এই সংজ্ঞাটা ব্যবহার করার কারণ, ক্রিকেটে যে অর্থে মোমেন্টাম কথাটা ব্যবহৃত হয়, এ দিয়ে তা পরিষ্কার বোঝানো যায়। এবার সংজ্ঞাটার সঙ্গে ওয়ানডে সিরিজটা মিলিয়ে নিন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও বাংলাদেশের জয়কে যদি ‘একটা ঘটনার শুরু’ ধরে নিই, দ্বিতীয় ম্যাচেও সেটিতে ‘উন্নয়নশীল ও বিকাশমান’ রেখেছিল ওই মোমেন্টাম। যেটির অনুবাদ ৩০২ রানের বিশাল স্কোর গড়ার পর হেসেখেলে পাওয়া জয়ে। তৃতীয় ওয়ানডের ২২তম ওভার পর্যন্তও যা ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে বাংলাদেশ ১ উইকেটে ১০৪।
আরেকটি তিন শ ছাড়ানো স্কোর যখন খুবই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। সেখান থেকে ১৯২ রানে অলআউট হয়ে গিয়ে বাংলাদেশের ম্যাচ হেরে যাওয়ার একাধিক তাৎপর্য—
এক. ৩–০তে সিরিজ জিতে আরেকটি ‘বাংলাওয়াশ’–এর গল্প লিখতে না পারা।
দুই. আরও ১০ পয়েন্ট যোগ করে আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে অবস্থান আরও সুসংহত করার সুযোগ হারানো।
তিন. যে ‘মোমেন্টাম’ নিয়ে এত কথা হলো, তা বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে আফগানিস্তানের অধিকারে চলে যাওয়া।
১০ পয়েন্ট পাওয়া না–পাওয়া শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে সরাসরি কোয়ালিফাই করা না–করার নির্ধারক হয়ে গেলে ভিন্ন কথা। নইলে সবার শেষে বলা হলেও তিন নম্বর কারণটাই হয়তো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ওয়ানডেতে আফিফ আর মিরাজের প্রায় অলৌকিক ওই জুটিতে হতচকিত আফগানিস্তান দ্বিতীয় ম্যাচেও সেটির জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই ম্যাচের প্রথম দেড় ঘণ্টাও ছিল সেটিরই ধারাবাহিকতা। এরপর বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতায় বদলে গেল দৃশ্যপট। মোমেন্টাম যেমন পাওয়া যায়, তেমনি হারানোও যায়। বাংলাদেশ তা হারিয়ে ফেলেছে, পেয়ে গেছে আফগানিস্তান।
আপনি অবশ্য বলতে পারেন, ওয়ানডে সিরিজ তো শেষই, এই মোমেন্টাম কি আফগানরা ভাজা করে খাবে নাকি! ওয়ানডে সিরিজ শেষ, ঠিক আছে। তবে সামনে তো দুই ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজ। এটা ঠিক যে দুই দলেই খেলোয়াড়ের বদল হচ্ছে, এমনকি বদলে যাচ্ছে অধিনায়কও। তারপরও সিরিজ–পূর্ব আবহে সর্বশেষ ম্যাচটার প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে অনেক খেলোয়াড়ই যেখানে কমন এবং টি–টোয়েন্টি রেকর্ডে আফগানিস্তান আগে থেকেই এগিয়ে। মিরপুরে দুই দলের ৬টি টি–টোয়েন্টির প্রথমটিতে জিতেছিল বাংলাদেশ, জিতেছে চট্টগ্রামে সর্বশেষটিতেও, কিন্তু মাঝখানে যে ৪টি ম্যাচ, তার সব কটিই দেখেছে আফগানিস্তানের জয়।
ওয়ানডে সিরিজে সম্ভাবনা জাগিয়েও যে ‘বাংলাওয়াশ’ হলো না বলে আমাদের আফসোস; টি–টোয়েন্টিতে উল্টো একবার ‘আফগানওয়াশ’–এর দুঃস্মৃতিও আছে। ২০১৮ সালের জুনে দেরাদুনে তিন ম্যাচ সিরিজে ৩–০ বাংলাদেশের ক্রিকেটে দুঃখের স্কেলে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে হারের প্রায় কাছাকাছি। আগামী বৃহস্পতি ও শনিবার মিরপুরে দুটি টি–টোয়েন্টি ম্যাচের আগে আফগানিস্তানকে সুখস্মৃতির আরেকটি উপলক্ষ এনে দিয়েছে ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ।
যে ম্যাচে অপরাজিত শতকে নায়কের আসনে রহমানউল্লাহ গুরবাজ, তবে জয়ের মঞ্চটা কিন্তু তৈরি করে দিয়েছেন দুই স্পিনার রশিদ খান ও মোহাম্মদ নবী। আগের ম্যাচেই ১০ ওভারে ৫৪ রান দিয়েছেন রশিদ। বাংলাদেশের বিপক্ষে যা তাঁর সর্বোচ্চ। চ্যাম্পিয়নরা যেভাবে ফেরে, সেভাবেই ফিরলেন এদিন ৩৭ রানে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে। ওয়ানডেতে ১৫০ উইকেটের মাইলফলকও ছোঁয়া হয়ে গেল এতে। সবচেয়ে কম ম্যাচে (৪৪) ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট তুলে নেওয়ার রেকর্ড তাঁর। ১৫০ উইকেটেও দ্রুততম হতে পারলেন না একটুর জন্য। পাকিস্তানি অফ স্পিনার সাকলায়েন মুশতাককে ১৫০ উইকেট পেতে ৭৫ ইনিংসে বোলিং করতে হয়েছিল। রশিদ খানকে করতে হলো মাত্রই এক ইনিংস বেশি।
শরিফুলের পরপর তিন ওভারে তিনবার ‘জীবন’ পাওয়া রহমানউল্লাহ গুরবাজের শতকে অবশ্যই একটু কালির দাগ লাগিয়েছে। স্কোরকার্ডে অবশ্য দাগ–টাগের অস্তিত্ব থাকে না। সেখানে লেখা: রহমানউল্লাহ গুরবাজ ১১০ বলে অপরাজিত ১০৬। দ্বিতীয় ম্যাচে লিটনের শতকের পর তাঁর রূপান্তর–হার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তা কথা হওয়ার মতোই, তবে গুরবাজ তো আরও অবিশ্বাস্য। নয় ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে যে তিনবার ৫০ পেরিয়েছেন, তিনবারই ছুঁয়েছেন তিন অঙ্ক! গত বছর জানুয়ারিতে ওয়ানডে অভিষেকেই শতক, পরের শতকটা এই গত জানুয়ারিতে। আসন্ন টি–টোয়েন্টিতে সিরিজেও গুরবাজ আছেন। টি–টোয়েন্টিতে প্রায় ১৪০ স্ট্রাইক রেটই তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের বোলারদের দুশ্চিন্তা করার কারণ হিসেবে যথেষ্ট ছিল, সঙ্গে যোগ হয়েছে এই শতক।
মোমেন্টাম বা ভরবেগ নিয়ে এত যে কথা, সেটা তো শুধু আফগানিস্তানই পায়নি, পেয়ে গেছেন রহমানউল্লাহ গুরবাজও।