ছয় পয়েন্টের ম্যাচ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই ছিল ম্যাচটা। হেরে গেলে আতলেতিকো মাদ্রিদের চেয়ে ৪ পয়েন্ট পিছিয়ে যেত বার্সেলোনা, সেরা চারে ওঠার দৌড়ে খেতে হতো বড় ধাক্কা। জিতে আতলেতিকোকে পয়েন্ট তালিকার পাঁচ নম্বরে ঠেলে দিয়ে আতলেতিকোর চেয়ে ২ পয়েন্ট এগিয়ে আগস্টের পর আবার তালিকার চার নম্বরে উঠে এসেছে বার্সা। কাতালানদের কোচ জাভির বড় তৃপ্তি এটি।
যেকোনো ব্যবধানে জিতলেই হতো, বার্সেলোনা উঠেছে আতলেতিকোকে ৪-২ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। মৌসুমে এই প্রথম বড় কোনো ম্যাচে বার্সাকে এত দাপুটে দেখাল, মৌসুমের বাকি পথে বার্সাকে যা আত্মবিশ্বাস জোগাবে। জাভির বড় এক তৃপ্তির জায়গা এটিও।
তবে নিজেদের মাঠ ক্যাম্প ন্যু-তে প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের সামনে এমন জয়ে জাভির বড় তৃপ্তি সম্ভবত আতলেতিকো কোচ দিয়েগো সিমিওনেকে ‘বার্সার ফুটবল’ দেখিয়ে দেওয়ার! তা-ও শেষ ২১ মিনিট দশজন নিয়ে খেলে!
ঠিক ছন্দোবদ্ধ ফুটবল বা পেপ গার্দিওলার সময়ের মেসি-ইনিয়েস্তা-জাভিদের চোখধাঁধানো টিকি-টাকা খেলেছে বার্সা, এমন নয়। তবে ১০ মিনিটে জর্দি আলবার সমতাফেরানো গোলের পর থেকে ৬৯ মিনিটে দানি আলভেজ লাল কার্ড দেখার আগ পর্যন্ত বার্সেলোনা যেমন খেলেছে, সেটিকে জাভির অধীনে বার্সার সবচেয়ে দাপুটে ৫৯ মিনিট বলাই যায়।
৮ মিনিটে ইয়ানিক কারাসকোর গোলে পিছিয়ে পড়া বার্সা আলবার পর গাভি ও রোনাল্ড আরাউহোর গোলে বিরতিতেই গেছে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে চতুর্থ গোল আলভেজের। ৫৮ মিনিটে সুয়ারেজ একটি গোল ফেরত দিয়েছেন আতলেতিকোর হয়ে।
জাভির তৃপ্তির কারণ ম্যাচের আগে দুই কোচের কথার লড়াই। সিমিওনের রক্ষণাত্মক ফুটবল নিয়ে বছর তিনেক আগে এক অনুষ্ঠানে জাভি বলেছিলেন, সিমিওনে আতলেতিকোতে যে ফুটবল খেলান সেটি ‘বড় দলের সঙ্গে যায় না।’ আজ প্রথমবার জাভির অধীন বার্সার মুখোমুখি হওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে সে প্রসঙ্গে সিমিওনে দিলেন পাল্টা খোঁচা।
জানুয়ারির দলবদলে বার্সায় জাভির পছন্দের চার খেলোয়াড় কেনার প্রসঙ্গ টেনে বললেন, জাভি এখন বার্সায় নিজের পছন্দের ধাঁচের ফুটবল খেলাতে পারবেন। পাশাপাশি জাভি প্রায় পুরো ক্যারিয়ারই বার্সায় থাকার প্রসঙ্গ টেনে তাঁর আরেক খোঁচা, ‘জীবনে আপনার শুধু এক ধরনের অভিজ্ঞতাই হলে অন্য অভিজ্ঞতার মূল্য আপনি বুঝতে পারবেন না। যদি আপনি অন্য কোথাও যান, অন্য অভিজ্ঞতা পান, তাহলে বুঝতে পারবেন জীবন শুধু এক ধরনেরই অভিজ্ঞতার ব্যাপার নয়।’ ইঙ্গিত পরিষ্কার, জাভি বার্সেলোনার ধাঁচের ফুটবলের বাইরে কিছু বোঝেন না।
জাভি আজ ক্যাম্প ন্যু-তে বার্সেলোনার ধাঁচেই উত্তর দিয়েছেন। বল কেড়ে নেওয়ায় দারুণ ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে আতলেতিকোকে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা দেয়নি, বার্সেলোনার গোলগুলো এসেছে নিজেদের বক্সের সামনে বার্সার প্রেসিংয়ে অসহায় আতলেতিকো ডিফেন্ডারদের আত্মসমর্পনের কারণেই।
জানুয়ারির দলবদলে ক্লাবে যাওয়া চার খেলোয়াড়ের তিনজন—আদামা ত্রায়োরে, ফেরান তোরেস ও আলভেজকে শুরু থেকেই নামিয়েছেন জাভি। এর মধ্যে ত্রায়োরে ডান উইংয়ে টাচলাইনের পাশে গতিময় দৌড়ে, টাচলাইনের দিকে ঘেঁষে থেকে বার্সার জন্য ‘মাঠ বড় করে’ আতলেতিকোর রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। ফলস নাইন হিসেবে খেলা ফেরান তোরেস আতলেতিকো রক্ষণে ‘পকেট’ খুঁজে নিয়ে আক্রমণে প্রাণ দিয়েছেন। আর দানি আলভেজকে নিয়ে জাভি খেলেছেন দারুণ বুদ্ধির খেল। বলতে গেলে পেপ গার্দিওলার কোচিং বই থেকে একটা পাতা ধার করে নেওয়া কৌশল।
বায়ার্ন মিউনিখে ফিলিপ লামকে রাইটব্যাকে খেলালেও দলের আক্রমণের সময়ে ‘ইনভার্টেড ফুলব্যাক’ হিসেবে খেলাতেন গার্দিওলা। অর্থাৎ দল আক্রমণে উঠলে প্রথাগত রাইটব্যাকের মতো টাচলাইন ধরে উঠে না গিয়ে মাঝমাঠের দিকে ঢুকে যেতেন লাম। আলভেজকে আজ সে ভূমিকায়ই খেলিয়েছেন জাভি। তাতে আলভেজের বল পায়ে দারুণ দক্ষতার পুরো সুবিধা যেমনি পেয়েছে বার্সা, তেমনি আতলেতিকোর আক্রমণের সময়ে মাঝমাঠের কেন্দ্র থেকে রাইটব্যাকে দৌড়ে যেতে ৩৮ বছর বয়সী আলভেজকে তেমন হাঁপাতেও হয়নি!
কৌশলটা সাফল্য পেতে অবশ্য একটু সময় লেগেছে। ৮ মিনিটে যে প্রথম গোলটা পেয়েছিল আতলেতিকো! বার্সা লেফটব্যাক জর্দি আলবাকে ফাঁকি দিয়ে লুইস সুয়ারেজ দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে মাঝমাঠ থেকে দারুণ থ্রু বাড়ান রদ্রিগো দি পল, সেটি ধরে সুয়ারেজের পাসে গোল ইয়ানিক কারাসকোর। তিন পাসের দারুণ সমন্বয়ে গোলে আতলেতিকোই ম্যাচে প্রাণ জোগাল।
কিন্তু বার্সার ফিরতে সময় লাগেনি। দারুণ প্রেসিংয়ের পর ১০ মিনিটে আলভেজের ভাসানো পাসে আলবার ভলিতে সমতায় বার্সা। এরপর থেকেই বার্সার দাপটের শুরু। ২১ মিনিটে গতির ঝলকে আতলেতিকো লেফটব্যাক মারিও এরমোসোকে পেরিয়ে আদামা ত্রায়োরের ক্রস, তাতে হেড করে গোল গাভির। ৪৩ মিনিটে সুযোগসন্ধানী গোলে ক্যাম্প ন্যু-তে উচ্ছ্বাস আরও বাড়িয়ে দিলেন আরাউহো।
কিন্তু বার্সার গোলোৎসব তখনো শেষ হলে তো! ৪৯ মিনিটে বক্সের ওপরে বল পেয়ে দারুণ হাফভলিতে গোল আলভেজের। আতলেতিকোকে তখন যেন ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না!
এর মধ্যেও ৫৮ মিনিটে সুযোগসন্ধানী গোলে আতলেতিকোয় আশা ফেরান বার্সেলোনারই সাবেক স্ট্রাইকার সুয়ারেজ। তাতে ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বীতা জমবে আশা করা যাচ্ছিল, জমল নাটক।
৬৯ মিনিটে পেছন থেকে আতলেতিকোর কারাসকোর পা মাড়ানোয় লাল কার্ড দেখলেন আলভেজ! গোল করানো, গোল করা, লাল কার্ড দেখা...এক ম্যাচে সব রঙই দেখা হয়ে গেল ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাকের।
কিন্তু দশজনের বার্সার ওপর আতলেতিকো চড়াও হলেও গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। ম্যাচে রঙ যা চড়ল শুধু রেফারির কার্ডেই। রেফারির সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় মাত্রা ছাড়িয়ে বার্সেলোনার সহকারী এক কোচ দেখলেন লাল কার্ড, কিছুক্ষণ পর একই দোষে হলুদ কার্ড দেখেন জাভি।
এতকিছুর মধ্যে বদলি নেমে বার্সেলোনার জার্সিতে অভিষেক হয়ে গেল জানুয়ারির দলবদলের শেষে আর্সেনালের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর ‘ফ্রি এজেন্ট’ হিসেবে বার্সায় যাওয়া পিয়ের-এমেরিক অবামেয়াংয়েরও। ৩২ বছর বয়সী স্ট্রাইকার অবশ্য তেমন ঝলক দেখাতে পারেননি।
সেটির দরকারও পড়েনি। আতলেতিকো যে উল্টোদিকে বার্সাকে ভোগাতে পারেনি। সিমিওনের বার্সার মাঠে জেতাও আর হয়নি।