ঈশ্বরের হাতে শান্তির খোঁজে ম্যারাডোনা
গ্যারি লিনেকার কী চমৎকার এক টুইট করেই না শ্রদ্ধা জানালেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রতি! ২৫ নভেম্বর রাতে যখন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখনই সাবেক ইংলিশ তারকার টুইট।
ম্যারাডোনা-বন্দনার সঙ্গে দারুণ একটা কথা দিয়েই লিনেকার শেষ করেছিলেন তাঁর টুইটটি, ‘আশা করছি সে এখন ঈশ্বরের হাতে শান্তি খুঁজে পাবে।’
‘ঈশ্বরের হাত’ কথাটি ম্যারাডোনার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ছিল যে মৃত্যুতেও তিনি তা এড়াতে পারেননি এটি। গ্যারি লিনেকার তাঁর শোক প্রকাশের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ‘ঈশ্বরের হাত’ জুড়ে দেবেন, ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাতের’ শিকার যে হয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর দলই!
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই ‘ঈশ্বরের হাতের’ সহায়তা নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার মৃত্যুসংবাদ ইংলিশ গণমাধ্যমও দিয়েছে ‘ঈশ্বরের হাত’ ব্যবহার করেই। দ্য সান শিরোনাম করেছেন, ‘ইন দ্য হ্যান্ড অব গড’।
মেট্রোর শিরোনামটা খুবই সহজ, স্বাভাবিক, ‘ম্যারাডোনা ইন দ্য হ্যান্ড অব গড’। ইংলিশ মিডিয়া কিংবা ইংলিশ গণমাধ্যমকে যে ‘ঈশ্বরের হাত’–এর স্মৃতি চিরদিন তাড়িয়ে বেড়ায়, ম্যারাডোনা মরে গিয়ে যেন সেটিই প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ একান্তই ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হয়ে আছে। বলতে গেলে গড়পড়তা এক দল নিয়েই আর্জেন্টিনাকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল তাঁর সেই কীর্তিকেই আরও মহিমান্বিত করেছে।
ঈশ্বর সেদিন সত্যিই ভর করেছিলেন ম্যারাডোনার মধ্যে। নয়তো হাত দিয়ে গোল করে নিন্দিত হওয়ার জবাবটা পরের গোলে ম্যারাডোনা যেভাবে দিয়েছিলেন, সেটি তো কেবল রূপকথার গল্পেই খুঁজে পাওয়া যায়।
মাঝমাঠে বল পেয়ে ছয়জন ইংলিশ ফুটবলারকে সাতবার কাটিয়ে গোল! ফুটবলের সর্বকালের সেরা গোলটি করে চিরস্থায়ী হয়ে যান ফুটবলের হল অব ফেমে।
ইংলিশরা ম্যারাডোনার হাত দিয়ে করা প্রথম গোলটির জন্য তাঁকে অভিশাপ দিতে পারে, কিন্তু পরের গোলেই আর্জেন্টাইন তারকার ফুটবল-জাদুর কাছে হার মেনে তাঁকে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে বসাতে বাধ্য। ঈশ্বর যেন এভাবেই সবকিছু সাজিয়ে দিয়েছিলেন।
ছিয়াশির বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইংল্যান্ডের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল তলানিতে। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে খুব বাজেভাবে মার খেয়েছিল আর্জেন্টিনার সেনাবাহিনী।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের শেষ আটে যখন আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড মুখোমুখি হলো, তখন দুই দেশের গণমাধ্যমই তাতিয়ে দিয়েছিল দুই দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের মনোভাব তো ছিল যেন তাঁরা মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে লড়েই ব্রিটিশদের কাছ থেকে ফকল্যান্ড দখল করে নেবেন।
আর্জেন্টিনা সেদিন যেকোনো মূল্যে জিততে চেয়েছিল। নিতে চেয়েছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই এমন অবিশ্বাস্য একটা চেহারা নেবে, সেটা কে ভেবেছিল!
ম্যারাডোনা অবশ্য কখনোই হাত দিয়ে গোল করা নিয়ে কোনো অনুতাপে ভোগেননি। বরং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, তিনি খেলার মাঠে সেদিন কোনো প্রতারণার আশ্রয় নেননি।
বলে হাত লাগিয়ে তা ইংলিশদের জালে পাঠিয়েছিলেন রেফারির চোখে ধুলা দিয়ে। তিনি সব সময়ই সেটিকে ‘একধরনের খেলা’ হিসেবে নিতে অনুরোধ করতেন। কিন্তু ইংলিশরা সেই অনুরোধ রাখবে কেন! সেই গোলেই যে বিশ্বকাপের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাদের।
ম্যারাডোনা গোলটা করেছিলেন ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে টেক্কা দিয়ে। ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, ‘লাফানোর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম শিলটনকে ডিঙিয়ে আমি বলে মাথা লাগাতে পারব না। সেটি আমাদের উচ্চতার তারতম্যের কারণেই। মুহূর্তে আমি বলে হাত লাগিয়ে দিই। আমার মনে আছে ইংলিশ ডিফেন্ডার টেরি বুচার চিৎকার করে বলছিল, “হাত ব্যবহার করেছে ও, হাত ব্যবহার করেছে...।” সে লাইন্সম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। অন্য ইংলিশ খেলোয়াড়েরাও টেরির সঙ্গে চিৎকার করছিল।’
গোলটা করেই ম্যারাডোনা কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। সতীর্থ আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের বলছিলেন, তাঁর দিকে ছুটে যেতে। ম্যারাডোনার মনে শঙ্কা ছিল যেকোনো সময় রেফারি নিজের ভুল বুঝতে পেরে গোলটি বাতিল করে দিতে পারেন।
কিন্তু ম্যারাডোনার সেই গোলটি রেফারি বাতিল করলেন না। নিজের ভুল চেপে যেতে চাইলেন। ম্যারাডোনার সেই গোলটিই ‘ঈশ্বরের হাত’–এর গোল। এমন নাম তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন! তাঁর ব্যাখ্যা ছিল খুবই সহজ। যে হাতে তিনি গোল করেছিলেন, সেটি তো ঈশ্বরেরই দেওয়া।
আসলে ঈশ্বর যেন সে ম্যাচে ম্যারাডোনার জন্য উপহারের পসরাই সাজিয়ে বসেছিলেন। ওই যে ৬ ইংলিশ খেলোয়াড়কে সাতবার কাটিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে করা শতাব্দীসেরা সেই গোল!
হাতে দিয়ে করা গোলটি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা ইংলিশ খেলোয়াড়দের মুখেও সেদিন অস্ফুটে বেরিয়ে এসেছিল একটা শব্দই, ‘চমৎকার’!
আর লিনেকার কী বলেছেন, সেটি তাঁর মুখেই শুনুন, ‘সে ম্যাচে ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটি ছিল অবিশ্বাস্য। এমনিতেই মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামের মাঠ মোটেও ভালো ছিল না। সে মাঠে ম্যারাডোনা ছিলেন রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। আমি তাঁর সেই গোলে এতটাই মুগ্ধ ছিলাম যে আর একটু হলে জোরে হাততালিই দিয়ে উঠতাম। ব্যাপারটা কেমন হতো ভাবুন তো। আমি মাঠে খেলছি, আমার দেশের বিপক্ষেই গোল হওয়ার পর আমি তালি দিয়ে ফেলছিলাম!’
ঈশ্বরের মহিমা এমনই। তাঁর হাতে নিশ্চয়ই ম্যারাডোনা শান্তিতে ঘুমাবেন।