বর্ষীয়ান দুজন স্ট্রাইকার। টিভিপর্দায় এ দুজন খেলছেন, আজকে এটা দেখার পর হয়তো অনেকেই চোখ কচলেছেন। ভেবেছেন, 'ভুল দেখছি না তো?'
শুধু খেলছেন বললে ভুল বলা হবে। দুজন গোল করেছেন। নিজ নিজ দলের আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বীরদর্পে। আর এই দুই 'বুড়ো'র কল্যাণেই তর্কসাপেক্ষে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ উপহার দিয়েছে এবারের ইউরো।
বলা হচ্ছে অস্ট্রিয়ার মার্কো আরনাউতোভিচ ও উত্তর মেসিডোনিয়ার গোরান পানদেভের কথা। গোল পেয়েছেন দুজনই। এই দুজনের কল্যাণেই খেলায় রঙ চড়েছে বারবার। আর তৃপ্ত হয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরা। শেষমেশ অবশ্য শেষ ১২ মিনিটে দুই গোল করে পানদেভের উত্তর মেসিডোনিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে অস্ট্রিয়াই।
আরনাউতোভিচ ছাড়াও অস্ট্রিয়ার হয়ে গোল পেয়েছেন রাইট উইংব্যাক স্টেফান লাইনার ও স্ট্রাইকার মিকায়েল গ্রেগোরিটশ। মেসিডোনিয়ার গোলটি পানদেভের, তা তো আগেই বলা হলো।
কাকতালীয়ভাবে এ দুজনই ছিলেন জোসে মরিনিওর সেই বিখ্যাত ইন্টার মিলান দলে, আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে যে দলটা ট্রেবল জিতে ইতিহাস গড়েছিল।
আরনাউতোভিচ বেঞ্চ থেকে এসে প্রায়ই গোল করতেন ওই দলের হয়ে, আর পানদেভ তো মূল একাদশের অংশই ছিলেন। ওই দুজনই এক যুগ পর নিজ নিজ দেশের হয়ে ইউরোর মঞ্চে এভাবে আলো ছড়াবেন, কে জানত!
ম্যাচের শুরুতে অবশ্য এ দুজনকে নিয়ে তেমন আলোচনাই ছিল না। আলোচনা ছিল বরং ডেভিড আলাবাকে নিয়ে। কদিন আগে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া অস্ট্রিয়ার অধিনায়ককে কোন পজিশনে খেলানো হয়, সে নিয়ে আগ্রহ ছিল সবার।
সব্যসাচী খেলোয়াড় হওয়ার এই এক যন্ত্রণা, নিজের কোনো নির্দিষ্ট পজিশন থাকে না। যে সমস্যাটা আলাবার আজীবনই ছিল। ক্লাব ক্যারিয়ারে লেফটব্যাক, সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলা এই তারকা অবশ্য দেশের হয়ে মাঝমাঠেই খেলেছেন অধিকাংশ সময়ে। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার কিংবা লেফট উইঙ্গার হিসেবেও খেলেছেন।
আলাবার গোল ঠেকানোর প্রতিভার চেয়ে অস্ট্রিয়ার কোচেরা তাঁর গোল বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছেন বেশি। এবারও অমন কিছু হবে, এটাই আশা করেছিলেন সবাই।
কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ৩-১-৪-২ ছকে তিন সেন্টারব্যাকের একজন হিসেবে আলাবাকে খেলানো শুরু করলেন কোচ ফ্রাঙ্কো ফোডা, যে সেন্টারব্যাক হিসেবে গত কয়েক মৌসুম ধরেই নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন তিনি।
আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের মধ্যেই চলতে থাকল ম্যাচ। অস্ট্রিয়া হয়তো ভাবেওনি, উত্তর মেসিডোনিয়া এমন দুর্দান্ত খেলবে। তবু ম্যাচের প্রথম হাসি অস্ট্রিয়াই হাসে। লাইপজিগের মিডফিল্ডার মার্সেল সাবিৎসারের দুর্দান্ত এক উড়ন্ত বলে পা ঠেকিয়ে ১৮ মিনিটেই দলকে এগিয়ে দেন রাইট উইংব্যাক স্টেফান লাইনার।
উত্তর মেসিডোনিয়ার লেফট উইংব্যাক এগিয়ান আলিওস্কি ঠিকমতো দেখে রাখতে পারেননি লাইনারকে, আর সে সুবিধাটাই পুরোপুরি নিয়েছেন বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখের এই তারকা।
গোল খেয়ে উত্তর মেসিডোনিয়া মোটেও দমে যায়নি। বরং তারাও একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। গোল খাওয়ার পেছনে নিজের একটু দোষ ছিল, সেটা হয়তো মাথায় ছিল আলিওস্কির। সেই দোষ কাটাতে তিনি আরও দুর্দান্ত খেলা শুরু করেন।
বাঁ প্রান্ত থেকে তাঁর এক ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে সতীর্থ সাবিৎসারের গায়ে মেরে বসেন অস্ট্রিয়ান সেন্টারব্যাক মার্টিন হিন্টেরেগার। সেখান থেকে বল চলে যায় হিন্টেরেগারের পেছনে ওঁত পেতে থাকা স্ট্রাইকার পানদেভের কাছে। গোল আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছেন আলাবা আর গোলকিপার বাখম্যান, পারেননি। ২৮ মিনিটেই সমতায় ফেরে উত্তর মেসিডোনিয়া।
দ্বিতীয়ার্ধ আসতে না আসতেই অস্ট্রিয়ার কোচ ফ্রাঙ্কো ফোডা বুঝলেন, পানদেভদের হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। মূল স্ট্রাইকার সাশা কালায়জিচের জায়গায় নামালেন আরনাউতোভিচকে, উইঙ্গার ক্রিস্টোফ বমগার্টনারের জায়গায় নামানো হল স্ট্রাইকার গ্রেগোরিটশকে। ওদিকে সেন্টারব্যাক থেকে সরিয়ে আলাবাকে নিয়ে আসা হল লেফটব্যাক পজিশনে।
বিকল্প হিসেবে নামা এই দুজনের সঙ্গে আলাবা খেলার চেহারা পালটে দিলেন। উত্তর মেসিডোনিয়ার ম্যাচ ড্র করার বা জেতার যা একটু আশা ছিল, সেটাও উবে গেল তাতে।
৬৫ মিনিটের দিকেই এগিয়ে যেতে পারত অস্ট্রিয়া। গ্রেগোরিটশের দুর্দান্ত এক হেড ঠেকিয়ে দেন উত্তর মেসিডোনিয়ার গোলকিপার স্টোলে দিমিত্রিয়েভস্কি। কিন্তু মেসিডোনিয়া বেশিক্ষণ আটকাতে পারেনি এই স্ট্রাইকারকে। আলাবার নিখুঁত এক ক্রসে পা ঠেকিয়ে ৭৮ মিনিটে দলকে এগিয়ে দেন গ্রেগোরিটশ।
গোলটা খেয়েই যেন উত্তর মেসিডোনিয়ার মন ভেঙে যায়। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে আবার গোল খেয়ে বসল। দুর্দান্ত এক থ্রো ইনে ফ্লিক করে সামনে থাকা স্ট্রাইকার আরনাউতোভিচের কাছে বল বাড়ান লাইপজিগের মিডফিল্ডার কনরাড লাইমার। গোল করতে ভুল হয়নি আরনাউতোভিচের।
এককালের ক্লাব সতীর্থ এই বয়সে এসে গোল করে আলো কেড়ে নিচ্ছে, ব্যাপারটা বোধহয় বেঞ্চে বসে দেখতে ভালো লাগেনি এই মেজাজি স্ট্রাইকারের। কিংবা কে জানে, হয়তো মূল একাদশে ছিলেন না দেখে একটু রেগেই ছিলেন। গোল করার পর তাঁর উদ্দাম উদযাপন দেখে সেটাই মনে হলো। আলাবা-সাবিৎসারদের রীতিমতো কসরত করে থামাতে হয়েছে আরনাউতোভিচকে!