অথচ লিভারপুলের হয়ে তাঁর শুরুটা মনমতো হয়নি, অন্তত শিরোপার দিক দিয়ে।

দায়িত্ব নেওয়ার চার বছর পর্যন্ত লিভারপুলকে কোনো শিরোপা এনে দিতে পারেননি জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। এ সময়ে তিনবার কাপ ফাইনালে উঠেছিল লিভারপুল।
২০১৬ সালের লিগ কাপ ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে, ইউরোপা লিগের ফাইনালে সেভিয়ার বিপক্ষে, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে হতাশাই সঙ্গী হয়েছিল লিভারপুলের। কান পাতলেই নিন্দুকদের গুঞ্জন শোনা যেত, ক্লপ শুধু শিষ্যদের আলিঙ্গনই করতে পারেন, লিভারপুলের ট্রফিখরা ঘোচানো তাঁর কম্মো নয়। ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে নিন্দুকদের দিকে তাকিয়ে ক্লপ চাইলে মুচকি হেসে নিতেই পারেন।

লিভারপুলকে শেষ চারটা কাপ ফাইনালই জেতালেন ক্লপ
ছবি : রয়টার্স

গত রাতে ইংলিশ লিগ কাপের (কারাবাও কাপ) ফাইনালে চেলসিকে হারিয়েছে লিভারপুল। গোলশূন্য ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে দীর্ঘ এক পেনাল্টি শুটআউট। এই ট্রফি জয়ের মাধ্যমে লিভারপুলকে শেষ চারটা কাপ ফাইনালই জেতালেন এই জার্মান ম্যানেজার। সেই ২০১৮-১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে টটেনহামকে হারিয়ে থেকে জয়ের শুরুটা হয়েছিল, পরের মৌসুমে চেলসিকে উয়েফা সুপার কাপ ফাইনাল আর ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গোকে ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে হারিয়েছিল লিভারপুল। টানা চার শিরোপার শেষটা এসেছে গত রাতে। চেলসির বিকল্প গোলকিপার কেপা আরিজাবালাগার পেনাল্টি মিসের মাধ্যমে।

রেকর্ড নবমবারের মতো লিগ কাপ জিতেছে লিভারপুল
ছবি : রয়টার্স

ওদিকে কোচের মতো রেকর্ড বইয়ে নাম লিখিয়েছেন লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসনও। লিভারপুলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধিনায়কদের তালিকায় কয়েক বছর আগেও যার নাম নেওয়া হতো না। কিন্তু একে একে সব বাধা পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এমন এক উচ্চতায় চলে গিয়েছেন, লিভারপুল-রূপকথায় এখন হয়তো জেরার্ড-ডালগ্লিশদের সঙ্গে একই সঙ্গে উচ্চারিত হবে এই ইংলিশ মিডফিল্ডারের নাম। হেন্ডারসনই একমাত্র অধিনায়ক, যিনি লিভারপুলের হয়ে একই সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, সুপার কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ ও লিগ কাপের শিরোপা জিতেছেন। এই এক তালিকায় হেন্ডারসন এখন জেরার্ড, অ্যালান হানসেন, ইয়ান রাশ, জন বার্নস, গ্রায়েম সুনেস, এমলিন হিউজ, রন ইটস ও ফিল টমসনদের মতো অধিনায়কদেরও ওপরে।

গোলকিপার কেলেহারের সঙ্গে হেন্ডারসন
ছবি : রয়টার্স

প্রথম থেকেই আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে দর্শকদের মধ্যে রোমাঞ্চ ছড়াতে থাকে চেলসি-লিভারপুল। লিভারপুলের মূল গোলকিপার আলিসন বেকার হলেও পুরো মৌসুমে লিগ কাপের ম্যাচগুলোতে খেলেছেন বিকল্প গোলকিপার খুইভিন কেলেহার। লিভারপুলের ফাইনালে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখা এই গোলকিপারের ওপরেই ফাইনালে ভরসা রেখেছিলেন ক্লপ, আলিসন ফিট থাকা সত্ত্বেও। চেলসির কোচ টমাস টুখেল অবশ্য অত আবেগের ভেতর দিয়ে যাননি, চেলসিকে লিগ কাপের ফাইনালে তোলার পেছনে স্প্যানিশ গোলকিপার কেপা আরিজাবালাগার অবদান থাকলেও ফাইনালে নামিয়ে দিয়েছিলেন দলের মূল গোলকিপার এদুয়ার্দ মেন্দিকে।

দুই গোলকিপারই কোচের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন গোটা ম্যাচে। পুরো ম্যাচে দুজন মিলে সেভ করেছেন দশটা। এদিকে পুলিসিকের শট কেলেহার আটকে দিচ্ছেন, তো ওদিকে মানে-ফন ডাইককে হতাশ করছেন মেন্দি। একাধিকবার অফসাইডের খাঁড়ায়ও পড়েছেন দুই দলের তারকারা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডের ফ্রি-কিক থেকে মানের হেডে বল চলে যায় ডিফেন্ডার জল মাতিপের কাছে, ক্যামেরুনের এই ডিফেন্ডার হেড করে বল জালে জড়ান। কিছুক্ষণ পর ভিএআরের সাহায্যে দেখা যায়, গোল হওয়ার সময় অফসাইডে ফন ডাইক, ফলে সে গোল বাতিল হয়ে যায়।

পরে অফসাইডের কারণে গোলবঞ্চিত হয়েছেন চেলসির রোমেলু লুকাকু, কাই হাভার্টজ। অবিশ্বাস্যভাবে পোস্টের বাইরে শট মেরেছেন মেসন মাউন্ট, নাবি কেইতারা। মাউন্ট তো আরও এককাঠি সরেস, অসাধারণ একটা সুযোগ নষ্ট করেছেন পোস্টে মেরে। শেষমেশ মূল ম্যাচের ৯০ মিনিট আর অতিরিক্ত সময়ের ৩০ মিনিট পরও যখন মীমাংসা হলো না, ম্যাচ গড়াল পেনাল্টি শুটআউটে।


শুটআউটের জন্যই মূল গোলকিপার মেন্দিকে তুলে এনে বিকল্প গোলকিপার কেপাকে নামিয়ে ২০১৪ বিশ্বকাপে ডাচ্‌ কোচ লুই ফন হালের সেই কীর্তি মনে করিয়ে দিলেন টুখেল। কোস্টারিকার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটের ঠিক আগ দিয়ে মূল গোলকিপার ইয়াসপার চিলেসেনকে তুলে টিম ক্রুলকে মাঠে নামিয়েছিলেন ফন হাল। যুক্তি ছিল, চিলেসেনের চেয়ে পেনাল্টি ঠেকানোর দিক দিয়ে ক্রুল বেশি দক্ষ। সে রাতে ফন হালের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করেছিলেন ক্রুল।

উঠে যাচ্ছেন মেন্দি, মাঠে নামছেন কেপা
ছবি : রয়টার্স

শুধু কেপাই পারলেন না গত রাতে। লিভারপুলের হয়ে প্রথম পাঁচ শটেই গোল করলেন যথাক্রমে জেমস মিলনার, ফাবিনিও, ভার্জিল ফন ডাইক, ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও মোহাম্মদ সালাহ। চেলসিও কম যায় না। মার্কোস আলোনসো, রোমালু লুকাকু, কাই হাভার্টজ, রিস জেমস ও জর্জিনিওর কল্যাণে তাঁরাও পাঁচবার বল জালে জড়াল। ম্যাচ গড়াল সাডেন ডেথে। এখন যে দল একটা শট মিস করবে, সেই শিরোপা হারাবে।
সাডেন ডেথেও লিভারপুলের হয়ে একে একে গোল করলেন দিওগো জোতা, দিভক অরিগি, অ্যান্ডি রবার্টসন, হার্ভি এলিয়ট ও ইবরাহিমা কোনাতে। চেলসির হয়ে গোল করলেন আন্তোনিও রুডিগার, এনগোলো কান্তে, টিমো ভেরনার, থিয়াগো সিলভা ও ট্রেভো চালোবা।

পেনাল্টি মিসের পর কেপাকে সতীর্থদের সান্ত্বনা
ছবি : রয়টার্স

বাকি রইলেন দুই গোলকিপার। লিভারপুলের গোলকিপার কেলেহার গোল পেলেও কেলেহারকে পরাস্ত করতে পারলেন না কেপা। বল মারলেন আকাশে। আর তাতেই নিশ্চিত হলো, লিভারপুলের কাছেই যাচ্ছে শিরোপা।


আর এটাও নিশ্চিত হলো, টানা দুইবার ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে কাপ ফাইনাল হারের যন্ত্রণা সহ্য করা ক্লপকে তৃতীয়বার খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে না।