চুপ থাকলেই বরং নেইমার-রোনালদোদের ক্ষতি

রোনালদো, রুনি, নেইমাররা নিজের আত্মজীবনী বানানোর দিকে ঝুঁকছেনগ্রাফিকস : প্রথম আলো
একের পর এক ফুটবলারকে নিয়ে তথ্যচিত্র হচ্ছে, চলচ্চিত্রও। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে হয়েছে অনেক আগেই, স্টিভেন জেরার্ডকে নিয়েও। সম্প্রতি নেইমারকে নিয়ে তিন পর্বের সিরিজ এসেছে নেটফ্লিক্সে। এর কদিন পরই আমাজন প্রাইমে রুনিকে নিয়ে তথ্যচিত্র। নেটফ্লিক্সে রোনালদোর বান্ধবী জর্জিনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে দেখা হয়েছে রোনালদোর সঙ্গে তাঁর জীবন, সঙ্গে রোনালদোরও। এমনিতেই মহাবিখ্যাত এই খেলোয়াড়েরা কেন তাঁদের জীবনের গল্প নিজেরাই পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন? দ্য অ্যাথলেটিক এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য দুই পর্বে সেই লেখার অনূদিত রূপের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

রোনালদোকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রের পরিচালক অ্যান্থনি ওঙ্কে আবার খেলোয়াড়দের নিজেদের হয়ে সাফাই গাওয়ার বিষয়টিও সামনে এনেছেন, ‘অবশ্যই এ তথ্যচিত্র বানানোর পেছনে তাঁর একটি উদ্দেশ্য ছিল নিজের সাফাই গাওয়া। তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মেসিকে তিনি যেমন খেলোয়াড় হিসেবে পছন্দ ও শ্রদ্ধা করেন, একই সঙ্গে তিনি এটাও জানেন, উন্নতি করার জন্য দুজনেরই দুজনকে দরকার। তবে কখনো কখনো রোনালদো নিজেও হতাশ হয়ে পড়তেন এই ভেবে যে মেসি সব সময় প্রশংসাসূচক শিরোনাম পায় সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে, তিনি যা পান না।’

তবে এটাও সত্যি, ওঙ্কের চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ২০১৪-১৫ সালে, যখন রোনালদোর বিরুদ্ধে ক্যাথরিন মায়োরগা ধর্ষণের অভিযোগ তোলেননি। ২০১৭ সালে যে অভিযোগ তুলে মায়োরগা সবার নজরে আসেন। নেটফ্লিক্সের নেইমার-তথ্যচিত্রে যেমন ব্রাজিল তারকার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, রোনালদোর ব্যাপারটিও চেপে যাওয়া হতো না বলে জানিয়েছেন ওঙ্কে, ‘আমি অবশ্যই ব্যাপারটি নিয়ে রোনালদোর সঙ্গে কথা বলতাম। আপনাকে অবশ্যই এসব ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এমনভাবে, যাতে তাঁর আসল প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়। তবে এটাও সত্যি, সে ক্ষেত্রে আইনি খুঁটিনাটি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। এমন ঘটনার সঙ্গে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ জড়িয়ে থাকেন, যাঁদের কাছে ব্যাপারটি অনেক স্পর্শকাতর। ফলে ওই দিকও মাথায় রাখতে হয়। হ্যাঁ, এসব নিয়ে কথা বলা আনন্দের কিছু নয়, তাই বলে আমি যে ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতাম, সেটাও নয়।’

আরও পড়ুন

ক্রীড়া বাণিজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে তথ্যচিত্র বা চলচ্চিত্র বানানোর আরেকটি কারণের কথা জানিয়েছেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ড্যান টুনা, ‘এখন অনেক মাধ্যমের আবির্ভাব হয়েছে, যারা এমন তথ্যচিত্র চায়। ফলে খেলোয়াড়দের জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাণের ব্যাপারটি আগের চেয়ে অনেক গতি পেয়েছে। এখন নেটফ্লিক্স, আমাজন, ডিএজেডএন, ইলেভেন সবাই ক্রীড়া তারকাদের নিয়ে তথ্যচিত্র খুঁজছে। সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের স্বত্ব কেনার চেয়ে ক্রীড়া তথ্যচিত্র বানানোর খরচ অনেক কম। কোটি কোটি অনুসারী আছে, এমন ক্রীড়াবিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তথ্যচিত্র বানিয়ে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে ছেড়ে দেওয়ার খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তথ্যচিত্রগুলো চিরদিন থেকেও যাচ্ছে, হারাচ্ছে না।’

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে নেইমারকে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তথ্যচিত্র
ফাইল ছবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকার ব্যাপারটিও টেনেছেন টুনা, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তাঁরা জেনেছেন, জীবনের নানা বিষয় বাইরের দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা যায়। ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যদি তাঁদের জীবনের জানালা হিসেবে কাজ করে, এসব বড় তথ্যচিত্র নিঃসন্দেহে সদর দরজার ভূমিকা নেয়, যেখান দিয়ে ঢুকলে ওই ক্রীড়া তারকার জীবনের ৩৬০ ডিগ্রি সম্পর্কে জানা যায়।’

ঘুরেফিরে আলোচনাটি তথ্য নিয়ন্ত্রণের দিকেই চলে আসে। অলিভিয়েরা জানান, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের একটা ধারণা দিয়েছে, তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোন কোন বিষয় সবার সামনে উপস্থাপন করব, কতটুকু করব—এভাবে ক্রীড়া তারকারা আস্তে আস্তে বহির্বিশ্বের সামনে নিজেদের উন্মুক্ত করেন। তাঁরা বোঝেন, এভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারলে আখেরে নিজেরই লাভ। চুপচাপ থাকলে, কোনো কথা না বললেই বরং ক্ষতি।’

লিভারপুল ছেড়ে এলএ গ্যালাক্সির হয়ে খেলার বিষয়টা প্রাধান্য পেয়েছে জেরার্ডের তথ্যচিত্রে
ছবি : এএফপি

সাধারণ মানুষের কাছে খেলোয়াড়দের আরও মানবিক হিসেবে প্রমাণ করার ব্যাপারটিও এখানে বেশ গুরুত্ব পায়। ব্লেয়ার জানিয়েছেন, ‘তাঁরা এমন মানুষ, যাঁদের ছোটবেলা থেকেই অমানুষিক জীবনযাত্রার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়, যা হয়তো আমাদের কল্পনা নাগালই পাবে না। সদ্যই কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া একজন ছেলের ঘাড়ে পৃথিবীর সব চাপ দেওয়ার পর ৩৫ বছর বয়সে “যাও, নিজের রাস্তা মাপো” বললে কেমন মনে হয়, তা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারব না।’

অবশ্য টুনার মতে, একই কারণে উদ্বুদ্ধ হয়ে খেলোয়াড়েরা এমন কাজ আগেও করেছেন, তবে সেটি আত্মজীবনী প্রকাশ করার মাধ্যমে, ‘ব্যাপারটি অনেকটা আধুনিক যুগে আত্মজীবনী বের করার মতো। আগে খেলোয়াড়েরা কোনো বই প্রকাশকের সঙ্গে কোটি কোটি টাকা দিয়ে চুক্তি করতেন আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করার জন্য। ছায়া লেখকের সঙ্গে কয়েকবার বসতেন, জীবন নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। তথ্যচিত্রের ব্যাপারটিও একই। পার্থক্য শুধু এখানেই, তথ্যচিত্র দেখতে আরও অনেক কম সময় লাগে। রুনিরটাই ধরুন, ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটে আপনার এই তথ্যচিত্র দেখা শেষ হয়ে যাবে, যেখানে ওই একই খেলোয়াড়ের আত্মজীবনী পড়তে আপনার আরও অনেক সময় লাগবে। বলা বাহুল্য, তথ্যচিত্র দেখার ব্যাপারটি বই পড়ার চেয়ে অনেক চমকপ্রদও বটে।’

সিমিওনে কি আসলেই এমন পাগলাটে?
ছবি: রয়টার্স

তথ্যচিত্রে অংশ নেওয়ার বিষয়টি খেলোয়াড়দের জন্য একধরনের থেরাপির কাজও করে। নিজের জীবন নিয়ে বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলা এক জিনিস, আর তথ্যচিত্রে খোলাখুলিভাবে কথা বলা আরেক জিনিস, যেখানে আপনি জানেন, আপনাকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রটি কোটি কোটি মানুষ দেখবেন। জেরার্ডকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানো ব্লেয়ার যেমন জানাচ্ছেন, ‘আমরা যখন তথ্যচিত্রটি বানাই, তখন তিনি (জেরার্ড) লস অ্যাঞ্জেলেসে ছিলেন। লিভারপুলে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষ করে মাত্র যোগ দিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সিতে। লিভারপুল ছাড়ার পর প্রথমবারের মতো নিজের ওই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সামনে কথা বলতে বসেছিলেন। তিনি তখন জীবনের এমন একটা পর্যায়ে ছিলেন, যখন তাঁর মনে হয়েছে, জীবনের এ অধ্যায় নিয়ে কথা বলা যায়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি দর্শককে সত্যি খুঁজে বের করার উপলক্ষ এনে দিচ্ছেন। নিজের জীবনের যে কঠিন সময়গুলোর কথা চিন্তা করছেন, সেগুলো নিয়ে কথা বলছেন। আমি জানি না, ব্যাপারটি তাঁর জন্য থেরাপির কাজ করেছে কি না।’

নিজেকে নিয়ে চলা বিতর্কের
ছবি: এএফপি

রুনির তথ্যচিত্রের নির্মাতা স্মিথ যেমন বলছেন, ‘আমার কাছে অনেক সময় মনে হয়েছে, তিনি জীবনের কঠিন অধ্যায়গুলো নিয়ে কথা বলতে বলতে একধরনের স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। মনে হয়েছে, এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলো নিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো সবিস্তারে কথা বলছেন।’

জনপ্রিয় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার লোভও অনেক ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের তথ্যচিত্র বানানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। জেরার্ড আর রোনালদোর তথ্যচিত্র বানানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা আসিফ কাপাডিয়া যুক্ত ছিলেন। এমন একজন মানুষ আপনাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর আগ্রহ দেখালে আপনি অবশ্যই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাইবেন।

তথ্যচিত্র বানানোর ব্যাপারে খেলোয়াড়দের নিজস্ব সংবেদনশীল চিন্তাভাবনারও একটা ভূমিকা থাকে। ওঙ্কে জানান, ‘মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে খেলোয়াড়েরা চিন্তা করেন, আমি আমার জীবন নিয়ে এমন একটা গল্প বলতে চাই, যা আমাদের সন্তানেরাও দেখতে পারবে, বুঝবে, আমি কেমন মানুষ ছিলাম। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। এই এই সময়ে আমার জীবনে কী কী চলছিল।’

রোনালদোর সঙ্গে কাটানো জর্জিনার নানান মুহূর্ত দেখা গিয়েছে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্রে
ফাইল

তথ্যচিত্র বানানোর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ—টাকা। যদিও এসব ক্ষেত্রে সরাসরি অত বেশি টাকাপয়সা পান না ক্রীড়া তারকারা। কিন্তু এর মাধ্যমে নিজের ব্র্যান্ড মূল্য যেভাবে বাড়িয়ে নেন, সেটাই ভবিষ্যতে আরও অনেক অর্থের সন্ধান করে দেয়। টুনা বলেন, ‘নিজেকে নিয়ে এসব তথ্যচিত্র বানালে অবশ্যই অনেক টাকা আসে। এই খেলোয়াড়দের অনেক পরামর্শক থাকেন, যাঁরা আর্থিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে খেলোয়াড়দের অবহিত করেন। ভবিষ্যতেও অনেক আর্থিক ও ব্যবসায়িক আয়ের পথ খোলা হয়ে যায় এর মাধ্যমে।’

এসব তথ্যচিত্র যে শুধু ক্রীড়াপ্রেমিকেরাই দেখেন, তা নয়। অনেক সময় এমন অনেক দর্শক এসব তথ্যচিত্র দেখেন, যাঁরা হয়তো নিয়মিত সেই খেলা অনুসরণও করেন না। তাঁরা শুধু মানুষটাকে চেনেন বলেই সে তারকার জীবনে কী চলছে, সে ব্যাপারে জানার জন্য তথ্যচিত্রটি দেখতে চান। তথ্যচিত্র দেখে সে খেলা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে সে খেলাটিরও দর্শক হয়ে যান। ফলে সম্পূর্ণ নতুন এক শ্রেণির দর্শকদেরও আকৃষ্ট করা সম্ভব এসব তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। ফর্মুলা ওয়ান নিয়ে নেটফ্লিক্স যে তথ্যচিত্রটি বানিয়েছে, সেটাই এর অনেক বড় প্রমাণ। ’ড্রাইভ টু সারভাইভ’নামের তথ্যচিত্র দেখার পর অনেকে ফর্মুলা ওয়ানের রেস দেখা শুরু করেছেন নিয়মিত।

নেইমারের তথ্যচিত্রের পোস্টার
ফাইল ছবি

তথ্যচিত্র বা চলচ্চিত্র তো হচ্ছেই, এরপর কী? এমনও হতে পারে, খেলোয়াড়েরা তথ্যচিত্রের মূল চরিত্র হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নেমে গেলেন। বেকহাম ও বাস্কেটবল তারকা লেব্রন জেমসের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে বিবিসির সিরিজ ‘ফিভার পিচ’-এর প্রযোজক ছিলেন বেকহাম; নেইমারকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রের প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন লেব্রন জেমস। ক্রীড়াঙ্গনে এসব নামের ওজন অনেক, তাই তাঁদের কেউ যদি পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার হোমরাচোমরা ব্যক্তিও হয়ে যান, আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।

সের্হিও অলিভিয়েরার মতে, ‘এটাকে স্ট্যাটাস বলতে পারেন, বলতে পারেন লিগ্যাসি কিংবা ঐতিহাসিক কোনো দলিল। আপনি তারকা হিসেবে যত বড় হবেন, আপনার ব্র্যান্ড ততই উচ্চতায় উঠবে। এসব তারকার অনেকে তাই নিজের জীবন নিয়ে এমন কিছু নির্মাণ করতে চান, যার শিল্পমূল্য থাকবে, যা দেখে দর্শক সেই খেলোয়াড়ের অর্জন ও প্রভাব সম্পর্কে বছরের পর বছর কথা বলে যাবেন।’

* দ্য অ্যাথলেটিক থেকে অনুবাদ : নিশাত আহমেদ

(শেষ)