কমলাপুরের টার্ফ বিতর্ক
ছয় বছরেই শেষ কমলাপুরের টার্ফ
দেশের ফুটবলে এখন আলোচনার কেন্দ্রে কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফ। সত্যিই কি এটি ফুটবলারদের জন্য চোটের ফাঁদ?
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম ম্যাচ হয়েছিল কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফে। এর পর থেকে পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগসহ এই মাঠে নিচের দিকের সব খেলাই হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা মিলিয়ে দিনে পাঁচটি ম্যাচ হওয়ারও নজির আছে কমলাপুর স্টেডিয়ামে। একটি টার্ফ দৈনিক যেখানে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা ব্যবহৃত হওয়ার কথা, সেখানে কমলাপুরের টার্ফ দৈনিক ব্যবহৃত হয় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা! মাত্র ছয় বছরেই তাই জীবনী শক্তি হারিয়েছে এই টার্ফ।
* ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ম্যাচ হয় কমলাপুরের টার্ফে। * ফিফার দেওয়া এই টার্ফ স্থাপনেই ছিল ত্রুটি। টার্ফের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। * অতি ব্যবহার আর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টার্ফ অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। * আগামী বছর ফিফার কাছে নতুন টার্ফ চাইবে বাফুফে।
করোনায় লম্বা সময় বিশ্রাম পেলেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কারের কারণে শীর্ষ দলগুলোকে নিয়ে কমলাপুরে স্বাধীনতা কাপ মাত্রই শেষ করেছে বাফুফে। জায়গায় জায়গায় টার্ফ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্বাধীনতা কাপে কয়েকজন ফুটবলার চোটে পড়েছেন। বসুন্ধরা কিংসের ডিফেন্ডার তপু বর্মণ, তারিক কাজী ও ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার জোনাথন ফার্নান্দেজের চোটে বেশ ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে চ্যাম্পিয়ন দলটি। ফুটবলাররা চোটে পড়তে পারেন ঘাসের মাঠেও। তবে কমলাপুরের মাঠে বাজে টার্ফও চোটে পড়ার একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চোটের শঙ্কায় বসুন্ধরা কিংস শেষ মুহূর্তে এবারের ফেডারেশন কাপ থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে। একই কারণ দেখিয়ে খেলছে না মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং উত্তর বারিধারাও। শাস্তি হিসেবে গতকাল ফেডারেশন কাপের গত দুবারের চ্যাম্পিয়ন কিংস ও বারিধারাকে আগামী ফেডারেশন কাপে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানাও করেছে বাফুফে। মুক্তিযোদ্ধাও পেতে পারে একই শাস্তি।
ঘরোয়া ফুটবলে কমলাপুরের বাজে টার্ফ নিয়ে এখন ক্লাব-বাফুফে মুখোমুখি। চলছে নানা নাটক, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না। টার্ফই যেন এখন দেশের ফুটবলের মূল সংকট! ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর এই টার্ফে প্রথম খেলেই ভিক্টোরিয়ার ডিফেন্ডার দিদার বলেছিলেন, ‘মাঠটা খুব ভারী ভারী লাগে। পায়ের পেশিতে ব্যথা হচ্ছে। এখানে চোটের ভয় বেশি।’
সেই ভয় এখন ছড়িয়ে পড়েছে শীর্ষ ক্লাবগুলোর কোচদের মনেও। তবে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি অনেকেই। চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ মারুফুল হক শুধু এটুকু বললেন, ‘মাঠের সংকট থাকায় কমলাপুরে খেলা হচ্ছে। আমরা স্বাধীনতা কাপ চালিয়ে নিয়েছি। ফেডারেশন কাপও চালিয়ে নেব। তবে টার্ফের অতি ব্যবহারে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। ফিফা অনুমোদিত টার্ফে ইনফিল নামে কিছু রাবারের দানা থাকে। কমলাপুরের টার্ফে এই দানা আগে থাকলেও এখন কম দেখছি। ফলে খেলোয়াড়ের পায়ে টান পড়তে পারে। বলের বাউন্স অসমান হচ্ছে। ইনফিল কমে যাওয়ায় কৃত্রিম ঘাসও কিছুটা দেবে গেছে।’
ফিফা অনুমোদিত টার্ফে ইনফিল নামে কিছু রাবারের দানা থাকে। কমলাপুরের টার্ফে এই দানা আগে থাকলেও এখন কম দেখছি।মারুফুল হক, কোচ, চট্টগ্রাম আবাহনী
বাফুফের মাঠ কমিটির সাবেক প্রধান ফজলুর রহমান (বাবুল) মনে করেন, এই টার্ফ ফুটবলারদের জন্য চোটের ফাঁদ, ‘টার্ফের গোড়াতেই গলদ। ফিফার অর্থায়নে এই টার্ফ যারা বসিয়েছে, সেই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এটি ঠিকভাবে স্থাপন করতে পারেনি। গত দু–তিন বছরে সংস্কারও তেমন হয়নি। টার্ফের ছোট ছোট ছিদ্রে বুটের স্পাইক ঢুকে যায়। এটা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে চোটের ফাঁদ।’
কেউ কেউ যদিও বলছেন, খেলোয়াড়েরা ফিট থাকলে এই টার্ফে মানিয়ে নিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে তপু বর্মণসহ অন্য ফুটবলারদের দাবি, ফিটনেস ভালো হলেও কমলাপুরের টার্ফ ফুটবলারদের জন্য নিরাপদ নয়। তাঁদের দাবি, এই টার্ফে খেলার সময় পা আটকে যায়। খেলোয়াড়েরা পড়ে গিয়ে ব্যথা পান। অবশ্য বাফুফে কর্মকর্তারা বারবার সামনে আনছেন ২২ ডিসেম্বর এই মাঠেই শেষ হওয়া সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের প্রসঙ্গ। তাঁরা বলছেন, এই টুর্নামেন্টে খেলতে কোনো বিদেশি দলই আপত্তি করেনি। মেয়েদের ফিটনেস কম হলেও তাঁরা কেউ চোটে পড়েননি।
ফিফার অর্থায়নে এই টার্ফ যারা বসিয়েছে, সেই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এটি ঠিকভাবে স্থাপন করতে পারেনি।ফজলুর রহমান, বাফুফের মাঠ কমিটির সাবেক প্রধান
বাফুফের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী তো উল্টো আক্ষেপ করলেন, ‘আমাদের সময় এমন মাঠ পেলে আরও অনেক ভালো খেলতাম। টার্ফে খেলার সুবিধা আছে। বর্ষায়ও খেলা যায়। মাঠ সমান, পাসিং ভালো হয়।’ কিন্তু সেটি তো মানসম্মত ভালো টার্ফে। কমলাপুর স্টেডিয়ামের মতো এবড়োখেবড়ো বাজে টার্ফে নয়। বাফুফে সহসভাপতিও তবু এই টার্ফকে চোটের ফাঁদ বলতে রাজি নন, ‘সময়ের সঙ্গে টার্ফ পুরোনো হয়েছে। কিন্তু এটি খেলোয়াড়দের জন্য চোটের ফাঁদ বলা যাবে না।’
তবে বাফুফেও অনুধাবন করছে, অতি ব্যবহারে কমলাপুরের টার্ফ জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এটি পরিবর্তন করা দরকার। সাধারণভাবে ৮-১০ বছর একটি টার্ফ টিকে থাকার কথা। সে হিসাবে কমলাপুরের টার্ফ টেকার কথা অন্তত ২০২৩ সাল পর্যন্ত। তবে এর আগেই ফিফার কাছে নতুন টার্ফ চাইবেন বলে জানিয়েছেন বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম, ‘আমরা প্রতি ১৫ দিন পরপর মাঠে বারারের দানা দিই। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করি। তবু টার্ফ ক্ষয় হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার শেষ হলে আগামী বছর ফিফার কাছে কমলাপুরের টার্ফ বদলের জন্য আবেদন করব।’