নন্দিত-নিন্দিত লাইপজিগ

নাম বুল্লি। লাইপজিগের মাসকট। পরশু শালকের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়ের পর তার উদ্‌যাপন দেখে কে বলবে খেলোয়াড়দের চেয়ে মাসকটের আবেগ কোনো অংশে কম! পরশু লাইপজিগের মাঠে l এএফপি
নাম বুল্লি। লাইপজিগের মাসকট। পরশু শালকের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়ের পর তার উদ্‌যাপন দেখে কে বলবে খেলোয়াড়দের চেয়ে মাসকটের আবেগ কোনো অংশে কম! পরশু লাইপজিগের মাঠে l এএফপি

বরুসিয়া ডর্টমুন্ড কোচ টমাস টুখেল মৌসুমের শুরুর দিকেই বলেছিলেন, ‘গত মৌসুমে ইংল্যান্ডে লেস্টার সিটির দুর্দান্ত গল্পটা আমরা জানি। লাইপজিগও তেমন কিছু করতে পারে।’ দিন চারেক আগে একই সুরে কথা বলেছেন বায়ার্ন মিউনিখ কোচ কার্লো আনচেলত্তিও, ‘লাইপজিগ দুর্দান্ত দল। আমি নিশ্চিত, মৌসুমের শেষ পর্যন্তই ওরা বড় হুমকি হয়ে থাকবে সবার জন্য।’
জার্মানির ফুটবলেই এখন একটা নাম সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে—আর বি লাইপজিগ। তবে ক্লাবটিকে নিয়ে এসব কথাবার্তায় আনচেলত্তি-টুখেলের মতো প্রশংসার সুর যেমন থাকছে, তেমনি থাকছে নিন্দার প্রকাশও।
প্রশংসা যা, সব মাঠের ফুটবল নিয়ে। এবারই ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম জার্মান ফুটবলের শীর্ষে উঠে এসেছে লাইপজিগ। এসেই চমক! মৌসুমে ১৩টি ম্যাচ হয়ে গেছে, এখনো অপরাজিত! ১০ জয়, ড্র ৩ টি। প্রথমবার জার্মানির শীর্ষ লিগে এসে এর আগে টানা অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি ছিল ১০ ম্যাচ পর্যন্ত (এমএসভি ডুইসবার্গ, ১৯৯৩–৯৪)।
শুধু কি তাই! এখন তো পয়েন্ট তালিকার শীর্ষস্থান নিয়েই বায়ার্নের সঙ্গে ‘লুকোচুরি’তে নেমেছে রালফ হেইসেনহাটলের দল। এই সপ্তাহেই দেখুন, শুক্রবার রাতে মাইঞ্জকে ৩-১ গোলে হারিয়ে তালিকার ‘ছাদে’ উঠেছিল আনচেলত্তির দল, পরশুই আবার তাদের নামিয়ে আনল লাইপজিগ। ঘরের মাঠে শালকেকে ২-১ গোলে হারিয়ে আবার বায়ার্নের চেয়ে এগিয়ে গেছে ৩ পয়েন্টে।
তবে মাঠের বাইরের লাইপজিগ এ মুহূর্তে সম্ভবত জার্মানির সবচেয়ে নিন্দিত ক্লাব। যাকে প্রতিপক্ষ, এমনকি নিজেদের দলের অনেক সমর্থকও দেখেন রেড বুলের ‘ব্যবসায়িক কার্যক্রমের আরেকটি শাখা’ হিসেবে। ২০০৯ সালে অস্ট্রিয়ান এনার্জি ড্রিংক কোম্পানিটি মালিকানা কিনে নেওয়ার সময় অবশ্য নাম ছিল এসএসভি মারক্রানস্টাট, খেলত জার্মান ফুটবলের পঞ্চম স্তরে। এমনই দৈন্যদশা ছিল, নিজেদের এলাকা সাক্সোনির মানুষও ক্লাবটির নাম জানত কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। সেই ক্লাবটিকেই কিনে নেয় রেড বুল। কিনে নেওয়া বলতে ক্লাবের লাইসেন্স, জার্সি, নাম, ক্রেস্ট—সবকিছু।
ঝামেলার শুরুও সেখানেই। জার্মানিতে ক্লাবের নাম স্পনসরদের নামে হয় না। কাগজে-কলমে যদিও ‘আর বি’ মানে ‘রাজেন বলস্পোর্ট’, কিন্তু শুরু থেকেই ক্লাবটির মার্কেটিং বিভাগ সূক্ষ্মভাবে এর নাম প্রচলিত করেছে রেড বুল লাইপজিগ নামে। প্রশ্ন আছে ক্লাবের পরিচালনা পদ্ধতি নিয়েও। জার্মানির ফুটবলে একটা নিয়ম আছে ‘৫০ +১ ’, যা অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা নয়, ক্লাবের সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মালিক ও সদস্যদেরই। লাইপজিগ নিয়মটা মেনেই চলে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে বিনিয়োগকারী ও মালিক তো একই—রেড বুল। তার ফল, ডর্টমুন্ডে যেখানে বার্ষিক সদস্যপদের টিকিটের দাম ৬২ ইউরো, লাইপজিগে ১ হাজার!
এ কারণে সাত বছর ধরেই নিয়মিত বয়কট, প্রতিবাদ দেখছে লাইপজিগ। এবারই যেমন, জার্মান কাপের ম্যাচে ডায়নামো ড্রেসডেনের সমর্থকেরা কাটা ষাঁড়ের মাথা ছুড়ে মেরেছে মাঠে। এমনকি জার্মানিতে ‘প্লাস্টিক ক্লাব’ বলে পরিচিত হফেনহেইমের সমর্থকেরাও মৌসুম শুরুর ম্যাচে লাইপজিগকে ব্যঙ্গ করে ব্যানার বানিয়েছে, ‘আমরা আমাদের সিংহাসন ফেরত চাই: জার্মানির সবচেয়ে অপছন্দের ক্লাব!’
এসবের মধ্য দিয়েই সিঁড়ি ভেঙে এগোচ্ছে লাইপজিগ। সাত বছরের মধ্যে পঞ্চম স্তর থেকে উঠে এসেছে বুন্দেসলিগায়। এখানেও যেন ভয়ডরহীন। ১৩ ম্যাচে গোল করেছে বায়ার্নের সমান ২৯টি (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, সবচেয়ে বেশি ডর্টমুন্ডের ৩১ টি)। খেয়েছে তৃতীয় সর্বনিম্ন ১১ টি। ডর্টমুন্ডকে হারিয়েছে, দুবার পিছিয়ে পড়েও জিতেছে লেভারকুসেনের বিপক্ষে। পরশু হারিয়েছে শালকেকেও। এমনই অবস্থা, ২১ ডিসেম্বর বায়ার্নের সঙ্গে ম্যাচটিই হয়ে যেতে পারে এবারের বুন্দেসলিগার শিরোপা নির্ধারক! প্লট গড়ে দিতে পারে ‘জার্মানির লেস্টার’ গল্পেরও।
তবে সেই গল্পটা ভার্ডি-মাহরেজদের লেস্টারের মতো সমাদৃত হবে কি না সংশয় থাকছে!