বাঁধনছাড়া এক জীবনের গল্প
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস—কাসা রোসাদা। কফিনে শুয়ে আছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বাইরে জনতার ঢল। ভেতরে ম্যারাডোনার পরিবার। তাঁকে দেখে গেলেন শেষবারের মতো। রোসিও অলিভাও সেখানে থাকতে চেয়েছিলেন।
দেরি করে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ নাকি তাঁকে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু রোসিওর দাবি, তাঁকে আমজনতার সারিতে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল, পরিবারের একজন হিসেবে যা ভীষণ আপত্তিকর।
পরিবারের একজন?
ম্যারাডোনার ‘পরিবার’ নিয়ে কথা বলাটা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত, সেটি কেউই ঠিক করে বলতে পারে না। বুয়েনস এইরেসের অন্যতম বিপজ্জনক এলাকা ভিয়া ফিওরিতোর কুটিরে তাঁর জন্ম।
বাবা ডিয়েগো সিনিয়রের শরীরে গুয়ারানি ইন্ডিয়ান রক্ত। মা দালমার শরীরে ইতালিয়ান। দুজনে গত হয়েছেন পাঁচ বছর হলো। তাঁদের কাছে ম্যারাডোনার ফেরার সময় তাঁর রক্তের সম্পর্কের যাঁরা থেকে গেলেন, সেখানে রোসিও নামে কেউ নেই।
কিন্তু নামটা তাঁর ভক্তদের চেনা। এমন নাম আরও ছিল। পারিবারিক জীবন বলতে যে শুধু রক্তের সম্পর্কে ম্যারাডোনার ভরসা ছিল না!
ম্যারাডোনারা আট ভাই-বোন। দুই ভাই হুগো ও রাউল, পাঁচ বোন মারিয়া, রিতা, এলসা, অ্যানা ও ক্লদিয়া। তাঁদের সবার সঙ্গেই ডিয়েগোর যোগাযোগ ছিল আত্মিক। ১৯৯০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে ইউরোপ থেকে ফোনে কথা বলতে তাঁর মাসিক খরচ ছিল ১৫ হাজার ডলার।
বোন অ্যানার নাতি হারনান লোপেজ তাঁর প্রাণের ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেটে খেললেও তাঁর প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। কমতি ছিল শুধু ম্যারাডোনার নিজ ঘরে। সেটা কিসের, সম্ভবত ম্যারাডোনা নিজেও জানতেন না!
সংসার টেকেনি, কিন্তু এদিক-সেদিক থেকে দাবি উঠেছে, ‘ম্যারাডোনা আমার বাবা’! চাওয়া হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষাও। ম্যারাডোনা গাঁইগুঁই করে কোথাও হার মেনেছেন, কোথাও-বা স্পিকটি নট।
তাঁর প্রথম যৌবনের প্রেমিকা ও প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়া ভিয়াফানের মেয়ে জিয়ান্নিনা গত বছর মজা করে বলেছিলেন, আর দু-একটি দাবি টিকে গেলেই নাকি একটা ফুটবল একাদশ বানানো যাবে!
১৯৭৯ সালে ১৭ বছরের কিশোরী ভিয়াফানের সঙ্গে ম্যারাডোনার পরিচয়, প্রণয় চলল দীর্ঘ ১০ বছর। ঘর বাঁধলেন দুজন। সেই ঘরেই দুই মেয়ে দালমা ও জিয়ান্নিনা (সের্হিও আগুয়েরোর সাবেক স্ত্রী)। মেয়েরা ছিল তাঁর হৃদয়ে। ২০১২ সালে জিয়ান্নিনা-আগুয়েরো বিচ্ছেদের পর সিটি তারকাকে ‘কাপুরুষ’ আখ্যা দেন সাবেক শ্বশুর।
ভিয়াফানের সঙ্গে ম্যারাডোনার দীর্ঘ ২৫ বছরের সম্পর্ক ভেঙে যায় ২০০৪ সালে বিচ্ছেদের কাগজে সই করে। দালমার চোখে সেরা সমাধান ছিল মা-বাবার এই বিচ্ছেদ। ওদিকে বাজারে জোর গুজব, ম্যারাডোনার ঘর ভেঙেছে তাঁর উড়ু উড়ু মন।
তবে ভিয়াফানে অধ্যায়ের শেষ ওখানেই হয়নি। পরেও দুজনের দেখা হয়েছে। যেমন ২০০৬ বিশ্বকাপে, আবার ২০১৮ সালে আদালতেও। টাকা চুরি করে ফ্লোরিডায় ফ্ল্যাট কেনার অভিযোগে ম্যারাডোনা মামলা ঠুকেছিলেন ভিয়াফানের বিরুদ্ধে।
ভিয়াফানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ম্যারাডোনার জীবনে আসেন ভেরোনিকা ওজেদা। কেউ বলেন স্ত্রী, কারও চোখে স্রেফ বান্ধবী। সে যা-ই হোক, ডিয়েগো ফার্নান্দো তাঁদের সন্তান।
আর্জেন্টিনার বারকর্মী ভ্যালেরিয়া সাবালিনের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া ছিল ম্যারাডোনার। ইয়ানা ম্যারাডোনার (অন্তর্বাস মডেল) জন্ম সাবালিনের গর্ভে। ম্যারাডোনার মস্তিষ্কে সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের সময় বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন ইয়ানা। দালমা ও জিয়ান্নিনাও ছিলেন সেখানে। জিয়ান্নিনা তাঁকে সহজভাবে নিলেও দালমা চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘খবরদার, আমাকে ছোঁবে না!’
ম্যারাডোনার কাছ থেকে সন্তানের অধিকার আদায় করতে ফুটবলার ডিয়েগো সিনাগ্রারই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নাপোলিতে থাকতে মডেল ক্রিশ্চিনা সিনাগ্রার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কিংবদন্তি। দুজনের ভালোবাসায় ১৯৮৬ সালে জন্ম নেন ডিয়েগো সিনাগ্রা।
কিন্তু ম্যারাডোনা তাঁর পিতৃত্ব স্বীকার করেননি। ১৯৯৩ সালে ক্রিশ্চিনার পক্ষে রায় দেন আদালত। ডিএনএ পরীক্ষার দাবি ওঠে। শোনা যায়, পোপ জন পলও নাকি হস্তক্ষেপ করেছিলেন এ বিষয়ে। কিন্তু ম্যারাডোনাকে কেউ নাড়াতে পারেনি। অবশ্য দীর্ঘ ৩০ বছর পর সিনাগ্রার দাবি মেনে নেন ম্যারাডোনা।
কিউবায় বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর তত্ত্বাবধানে মাদকাসক্তির চিকিৎসা নেওয়ার সময়ও রোমান্সে জড়িয়েছেন ম্যারাডোনা। মায়ের নাম অজানা, কিন্তু গত বছর জোয়ানা, লু ও জাভেলেই—এই তিন মেয়ের পিতৃত্ব মেনে নেন কিংবদন্তি।
২০১৬ সালে কাস্ত্রোর শেষকৃত্যে কন্যাত্রয়ীর সঙ্গে দেখাও হয় ম্যারাডোনার। হাভানা চুরুট আর বিপ্লবের দেশ থেকে তাঁকে বাবা দাবি করেছিলেন আরও একজন। কিন্তু সেটি ধোপে টেকেনি। যেমন কপাল পুড়তে পারে মাগালি গিল ও সান্তিয়াগো লারার।
তাঁরাও ম্যারাডোনাকে বাবা দাবি করে ডিএনএ পরীক্ষার দাবি তুলেছিলেন, কিন্তু সেসব আর হলো কোথায়, ম্যারাডোনা তো তার আগেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন!
মাগালি মায়ের কাছে শুনেছেন ম্যারাডোনা তাঁর বাবা। সান্তিয়াগোর দাবি, তাঁর মা নাতালিয়া ওয়েট্রেস থাকাকালে ম্যারাডোনার সংস্পর্শে এসেছিলেন।
সাবেক নারী ফুটবলার রোসিওর সঙ্গে ম্যারাডোনার পরিচয় ২০১২ সালে। দুই বছর পর নাকি দুজনের বাগদানও হয়েছিল। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার এক ম্যাচে ম্যারাডোনা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর পাশে ছিলেন বয়সে ৩০ বছরের ছোট রোসিও।
সে বছরই কয়েক দফা অদ্ভুত সব বাগ্বিতণ্ডার পরিণতিতে ছাড়াছাড়ি হয় দুজনের। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করা প্রচার হয়, ম্যারাডোনা নাকি রোসিওর গায়ে হাত তুলেছিলেন। চুরির অভিযোগ তুলে পরে ফিরিয়েও নেন।
প্রেয়সীর জন্য কেনা বাড়ি থেকে তাঁকেই গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ম্যারাডোনার নাকি এতটুকু বাধেনি।
সেই রোসিওরই অভিযোগ, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর কাসা রোসাদায় তাঁকে ঢুকতে দেননি ক্লদিয়া ভিয়াফানে, ‘কে ঢুকবে, সেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে ভিয়াফানে। জানি না ওরা এমন কেন করেছে আমার সঙ্গে। আমি তো শুধু তাকে বিদায় জানাতে চেয়েছিলাম। আমি তো তার শেষ সঙ্গী!’
কে জানে!