বালু তোলা শ্রমিক ছেলেটিকে ব্রাজিল নিয়ে যাচ্ছে ফুটবল

রনি মিঞ্চা, ফুটবল যাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেছবি: সংগৃহীত

বুট কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে খালি পায়েই ফুটবল খেলত রনি মিঞা। মাঝেমধ্যে ফুফাতো ভাইয়ের বুট ধার করে খেলত। কিন্তু আকারে বড় হওয়ায় সেই বুটজোড়া পরে খেলতে গিয়েও বিপত্তি। চোটে পড়ে খেলা থেকে ছিটকে যেতে হয় রনিকে।

শুধু চোট নয়, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা রনির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দারিদ্র্যের দেয়ালও। কিন্তু সব বাধা জয় করে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রনি। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে হবিগঞ্জের ১৬ বছরের কিশোরের বড় একটা ধাপ উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে যাওয়ার সুযোগ।

বাংলাদেশের কিশোর ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ নিতে ব্রাজিলে পাঠানোর উদ্যোগটা নেন ২০১৮ সালে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা দি অলিভিয়েরা জুনিয়র। তাঁর সহযোগিতা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চেষ্টায় দ্বিতীয়বারের মতো ব্রাজিলে যাচ্ছে বাংলাদেশের কিশোর ফুটবলারদের একটা দল। ২০১৯ সালে গিয়েছিল চারজন। এবার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১। সেই দলেরই একজন এই রনি।

সব ঠিক থাকলে আগামী মে মাসে ব্রাজিল যাবে ফুটবলাররা। বিকেএসপির চূড়ান্ত বাছাই শেষে রনি ফিরে গেছে হবিগঞ্জে। বর্তমানে জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তার মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত রনি। পুরো ব্যাপারটাই রনির জন্য স্বপ্নের মতো।

এখন শুধু ব্রাজিল যাওয়ার স্বপ্নে দিন গোনা
ছবি: সংগৃহীত

কাহিনিটা শুনলেই বুঝতে পারবেন কারণটা। রনিদের পরিবারের অবস্থা নুন আনতে পানতা ফুরানোর মতো। বৃদ্ধ বাবা তৈয়ব আলী পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে বেচতেন। সেই আয়ে কোনোরকম সংসার চলত। দুমুঠো ভাত না জুটলেও ফুটবল মাঠে মন পড়ে থাকত রনির। এভাবে খেলতে খেলতেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্কুল ফুটবলে খেলার সুযোগ হয়। সেখানে আলাদা করে সবার নজর কাড়ে রনি। এরপর সিলেট বিকেএসপিতে ট্রায়ালের পর সুযোগ মেলে সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার।

কিন্তু সেখানেও দেখা দেয় সমস্যা। বিকেএসপির নির্ধারিত মাসিক বেতন দিতে পারছিল না বলে পালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে রনি। ব্রাজিলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার আনন্দে ভেসে যেতে যেতে সেই কষ্টের দিনগুলো বড় মনে পড়ছে রনির, ‘আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বাবার কাছে বিকেএসপির বেতনের টাকা চাইলে দিতে পারতেন না। তাই বিকেএসপি ছেড়ে চলে আসি।’

বিকেএসপি ছাড়ার পর বাবাকে সাহায্য করতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে শ্রমিকের কাজে নেমে পড়ে রনি। এলাকার নদী থেকে বালু তোলার কাজ করে বাবার হাতে সেই টাকা তুলে দিত, ‘ওই সময় কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বাবার কষ্ট দেখে ভীষণ খারাপ লাগত। একপর্যায়ে বালু তোলার মেশিনের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি।’

রনির পছন্দের ক্লাব কোনটি, সেটি বোধ হয় গায়ে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিটা কিছুটা বলে
ছবি: সংগৃহীত

কাজের ফাঁকে এলাকায় বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নিত রনি। তেমনই এক টুর্নামেন্টে রনির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করে নেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক (সুমন)। কিন্তু ওই একাডেমিতে যেতেও আপত্তি ছিল রনির।

কারণটা ওই আর্থিক দুরবস্থা, ‘বড় ভাইকে বিদেশ পাঠাতে বাবা জমি বন্ধক রেখেছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ নেন। আমি বালু তুলতাম। ফুটবল খেললে বাড়তি কিছু পাব না, সেটা সুমন ভাইকে তখন জানিয়ে দিই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে এক লাখ টাকার চেক দেন এবং একাডেমিতে ভর্তি করে নেন।’

বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে বন্ধকি জমি ছাড়িয়ে নেয় রনি। এরপর নির্ভার হয়ে ব্যারিস্টার সুমনের একাডেমিতে খেলেছে তিন বছর। গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনূর্ধ্ব-১৭ গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় সিলেট বিভাগ। সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিল রনি।

খেলে রাইটব্যাক পজিশনে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বিভাগীয় দলে সুযোগ পেতে রনিকে পার হতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। শুরুতে ইউনিয়ন পর্যায়ের দলে খেলে রনি। সেখানে তার দল হারলেও ওই দল থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয় থানা পর্যায়ের দল। একইভাবে থানার সেরা খেলোয়াড়দের সুযোগ মেলে জেলা পর্যায়ের দলে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেই নজর কেড়েছে রনি
ছবি: সংগৃহীত

সর্বশেষে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার সেরা ফুটবলার নিয়ে গড়া হয় বিভাগীয় দল। এরপর দেশের ৮ বিভাগ থেকে সেরা ৪০ ফুটবলারের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়েছে ব্রাজিল সফরের জন্য ১১ জনকে। সেই বাছাইয়ে টিকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে রনি।

চুনারুঘাট কাচুয়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রের কণ্ঠে এখন ঘোরলাগা বিস্ময়, ‘কখনো ভাবিনি যে ফুটবলে ফিরব। অথচ ফুটবল খেলতে পেলে-নেইমারদের দেশে যাচ্ছি। কী যে ভালো লাগছে বলে বোঝানো যাবে না।’

গত বছর বাফুফের এলিট একাডেমিতে ট্রায়াল দিয়েছিল রনি। বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় এসে বাছাইয়ে অংশ নেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। তবে ফুটবলের লড়াইয়ে কখনো হাল ছাড়েনি, ‘সেবার আমি ও আমার বন্ধু এক সঙ্গে ট্রায়াল দিই। আমার ওই বন্ধু ট্রায়ালে টিকে যায়। কিন্তু বাদ পড়ার পর আরও ভালোভাবে অনুশীলন করার প্রতিজ্ঞা করি। কিছুদিন আগে ওই বন্ধু এলিট একাডেমি থেকে বাদ পড়ে। কিন্তু আমি এবার ব্রাজিলে যাচ্ছি।’