অনেকের চোখেই বাংলাদেশের ফুটবলে সেরা নাম কাজী সালাউদ্দিন। খেলোয়াড়ি দক্ষতার সঙ্গে তারকা ভাবমূর্তি যোগ করলে ‘আবাহনীর নাম্বার টেন’ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু শুধুই খেলোয়াড়ি দক্ষতার মানদণ্ডে দেশের ফুটবলে সেরা আসনে অন্য একজনকে বসান অনেকেই। যাঁর নাম এনায়েতুর রহমান খান। আজকের প্রজন্মের কাছে নামটি অচেনা হলেও এনায়েত সত্তর-আশির দশকে ছিলেন ঢাকা মাঠের সেরা বল প্লেয়ার।

১৯৭৩ সালে মালয়েশিার বিখ্যাত মারদেকা টুর্নামেন্টে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-২ ড্র ম্যাচে প্রথম গোলটি আসে তাঁর পা থেকেই। সেটিই বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। নিয়মিত খেলেছেন গর্বের স্বাধীন বাংলা দলেও।

সেই এনায়েত অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় থিতু হয়েছেন বহু আগে। দেশের ফুটবলে তিনি এখন ভুলে যাওয়া এক নাম। প্রবাসজীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলেন পরিবারের সঙ্গে। সাবেক এই তারকা ফুটবলার আজ আবার খবরে এলেন। দীর্ঘ ২৭ বছর পর আজ সকালে তিনি দেশে ফিরেছেন।

ফুটবলীয় আলোচনায় বলা হয়, তিনি অভিমানে দেশ ছেড়েছেন। দেশের ফুটবল তাঁকে কিছু দেয়নি (যোগ্য সম্মান) বলে সরে যান। তবে দেশের ফুটবলে কারও কারও চোখে সেরার মর্যাদাটা পাওয়াও তাঁর জন্য কম নয়। বহু বছর দেশে আসেননি। দেশ থেকে তাঁর সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকেরা যোগাযোগ করলে অনেক ক্ষোভ-অভিমানের কথা বলতেন। আকার–ইঙ্গিতে বোঝাতেন তিনি সেরা হলেও সংবাদমাধ্যমে সালাউদ্দিনকে নিয়েই বেশি মাতামাতি করত।

এসব নিয়ে কাজী সালাউদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বহুবার বলেছেন, ‘এনায়েতের সঙ্গে আমার কোনো লড়াই ছিল না। এই লড়াইটা আসলে মিডিয়ার তৈরি।’

যাই হোক, অবশেষে দেশে ফিরে তিনি খুশি। আপাতত দুই মাসের ছুটি। আজ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমকে এনায়েত বলেন, ‘অনেক দিন পর দেশে এলাম। এই অনুভূতি অন্য রকম। যারা ফুটবল খেলেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশ থেকে তারা দূরে থাকতে পারে না। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ অনেক কিছু করে। তাই প্রবাসে আছি।’

বিমানবন্দরে এনায়েতকে অভর্থ্যনা জানান সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার। তিনি বলেন, ‘এনায়েত ভাইকে এ দেশের ফুটবল কখনো ভুলবে না। অনেক দিন ধরে তাঁকে দেশে আসতে অনুরোধ করছিলাম। অবশেষে তিনি এসেছেন। ঢাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেবেন। এ ছাড়া আরও কিছু কাজও সারবেন।’

১৯৭০ সালে ভিক্টোরিয়া ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে তাঁর যাত্রা। তৎকালীন বিআইডিসি ক্লাবে ৭২-৭৩ মৌসুম কাটিয়ে ১৯৭৪ সালে আসেন ওয়াপদায়। বিজেআইসি বা তৎকালীন বিজেএমসিতে খেলেন ৭৫-৭৭ পর্যন্ত। ৭৮-৮০ কাটান মোহামেডানে। ১৯৮৫ সালে কয়েক মাস কোচ ছিলেন মোহামেডানের। ১৯৭৩ মারদেকা থেকে ১৯৭৮ ব্যাংকক এশিয়ান গেমস পর্যন্ত খেলেন জাতীয় দলে।

তাঁর পায়ে ছিল কামানের গোলার মতো শট। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভালো শুটার মনে করা হয় তাঁকে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। অনেকে মনে করেন, অল্প জায়গায় শরীর ঘুরিয়ে পোস্টে শট নিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সালাউদ্দিন। কিন্তু এনায়েত বল ধরতেন নিচ থেকে। থ্রু ধরে দ্রুত ওপরে উঠে গোল করতেন। বল প্লেয়ার হিসেবেই তাঁকে বেশি নম্বর দেন তাঁর সময়ের ফুটবলাররা।

তবে মেজাজি ফুটবলার ছিলেন এই মানুষটি। ১৯৭৮ সালে রেফারি দলিল খানকে মেরে একবার হইচই ফেলে দেন। ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে মোহামেডানের জার্সিতে ওই কাণ্ড করেন এনায়েত। তাঁকে প্রথমে ৫ বছর নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মোহামেডানের সমর্থকদের বিক্ষোভের জেরে কিছুদিন পর তুলে দেওয়া হয় শাস্তি।

এনায়েতকে মনে রাখতে হবে তাঁর সেই ফ্রিকিকের জন্যও। ১৯৭৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে ফ্রিকিক পায় বিআইডিসি। সাতজনের দেয়াল টপকে এনায়েত বল পাঠান জালে। গোলরক্ষক শহিদুর রহমান সান্টু কোনো সুযোগই পাননি বল আটকাতে। একবার রহমতগঞ্জের বিপক্ষে তাঁর ভলিতে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামের উত্তর দিকের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল বল। আজও ফুটবলীয় আড্ডায় এসব স্মৃতি রোমন্থন করেন অনেকে। সেই এনায়েত দুই যুগের বেশি সময় পর দেশে এসে আবার সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সত্তর-আশির দশকের জটজমাট ফুটবলীয় আবহে।