এই সেদিন তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলেছেন। এখন দেশের শীর্ষ স্তরে। (বাঁ থেকে) সুফিল, জাফর, রবিউল ও আবদুল্লাহর হাসিমুখই বলে দিচ্ছে কতটা রোমাঞ্চিত তাঁরা। কাল চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে দলীয় অনুশীলনের পর চার ফুটবলার l সৌরভ দাশ
এই সেদিন তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলেছেন। এখন দেশের শীর্ষ স্তরে। (বাঁ থেকে) সুফিল, জাফর, রবিউল ও আবদুল্লাহর হাসিমুখই বলে দিচ্ছে কতটা রোমাঞ্চিত তাঁরা। কাল চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে দলীয় অনুশীলনের পর চার ফুটবলার l সৌরভ দাশ

কোথায় ছিলেন আর কোথায় এলেন! আনমনে ভাবতে ভাবতে কদিন আগের স্মৃতিতে ফিরে যান ওঁরা চারজন। পেছনে তাকিয়ে দেখেন সেই স্মৃতিগুলো কত তরতাজা! এখনো শরীর থেকে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে খেলার গন্ধ যায়নি। অথচ আজ তাঁরা দেশের শীর্ষ ফুটবলের গর্বিত যাত্রী। তাঁদের কাঁধে ভর করে সদর্পে এগিয়ে চলেছে মতিঝিল ক্লাব পাড়ার দল আরামবাগ।

কী বলবেন এঁদের? আরামবাগের রত্ন? নাকি বলা উচিত, মাঝারি মানের দলটির স্বপ্নদিশারি? যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, ১৮-১৯ বছরের এই চার তরুণ যেন গল্পের কোনো চরিত্র। আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যেন বাদশা বনে গিয়ে বদলে ফেলেছেন নিজেদের ভাগ্য।

গত মার্চেই তাঁরা দিলকুশার জার্সি গায়ে তৃতীয় বিভাগ ফুটবলের আলো বাতাসে বেড়ে উঠছিলেন। ওই দলটাকে চ্যাম্পিয়নও করেন। এরপরই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, জাফর ইকবাল, রবিউল হাসান ও আবু সুফিয়ান সুফিলের সরাসরি ঠাঁই হলো প্রিমিয়ার লিগের দল আরামবাগে। দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ বা চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ—কোনো সিঁড়িতেই রাখতে হয়নি পা। এ যেন লিফটে চড়ে মুহূর্তেই ১০ তলায় উঠে যাওয়া!

স্বপ্নযাত্রাটা এখানেই থামেনি। আবদুল্লাহ আর জাফরের সামনে হুট করে খুলে গেছে জাতীয় দলের দরজাও। টম সেন্টফিট এসে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে তুলে দিলেন। সেই বিস্ময়টা আজও তাঁদের চোখেমুখে। দুজনই জাতীয় দলে দৃষ্টি কাড়তে পেরেছেন, খেলেছেন একাদশেও। বাকি দুজনের ভাবনার আকাশেও এখন ওড়াউড়ি করছে জাতীয় দলের ঘুড়ি।

জাফরের বাড়ি বান্দরবান শহরে। চট্টগ্রামের যে পুলিশ লাইন মাঠে দাঁড়িয়ে কাল বিকেলে দলের অনুশীলনের ফাঁকে কথা বলছিলেন, এই মাঠে খেলেছেন আগে। রবিউলের বাড়ি টাঙ্গাইল। আবদুল্লাহর সিরাজগঞ্জ, সুফিলের সিলেট। সাধারণ জীবন ছেড়ে তাঁরা এখন হোটেলে থাকেন, কিছুটা জমকালো জীবনেও ঢুকে পড়েছেন।

রাতারাতি এমন রূপান্তরের অনুভূতি কী? চারজনেরই সমস্বরে উত্তর,‌ ‘খুব ভালো। আমরা ভাবতে পারিনি জীবনটা হঠাৎ এমন বদলে যাবে।’ জাফরের সংযোজন, ‌‘আশা ছিল, আস্তে আস্তে সামনে এগোব। বড় দলে খেলব।’ আর রবিউলের বর্ণনায়, ‘আমাদের এই উঠে আসা একটা বিরাট ড্রামার মতো।’

সত্যি তাই। স্বপ্নের ঘোরেও নাকি তাঁরা ভাবেন, এটা কী করে সম্ভব! নিজেদের মেধা আর চেষ্টা তো ছিলই, সঙ্গে পেয়েছেন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। মাঝমাঠে খেলেন আবদুল্লাহ ও রবিউল। রাইটউইংয়ে সুফিল, বাঁয়ে জাফর। তাঁরা ‘জায়ান্ট কিলার’ পরিচয় ছাপিয়ে আরামবাগকে দিয়েছেন নতুন একটা চেহারা। জাফর ও আবদুল্লাহ লিগে গোল পেয়েছেন তিনটি করে। 

মাঠের বাইরে তাঁরা এক আত্মা, এক প্রাণ। একই রুমে থাকা হয় চারজনেরই, গড়ে উঠেছে একটা বন্ধন। একসঙ্গে আড্ডা মারতে ভালোবাসেন চারজন। সেখানে খেলা ছাপিয়ে সেখানে উঠে আসে পারিবারিক সুখ-দুঃখ। চারজনই সাধারণ পরিবারে ছেলে। রবিউল, আবদুল্লাহ, সুফিলের বাবা কিছু করেন না। সুফিলের ভাই মুদির দোকানে কাজ করেন। জাফরদের আছে মুদি দোকান। এখন তাঁরা সংসারের হাল একটু ধরতে পারছেন।

আর এই চারজনের হাল ধরে আছেন আরামবাগের কোচ সাইফুল বারী। শিষ্যদের নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস,‌ ‘চারটি ছেলেই প্রতিভাবান।’ তবে চার তরুণকে সবচেয়ে ভালো চেনেন আরামবাগের সহকারী কোচ নিজাম মজুমদার। দিলকুশায় এঁদের কোচ ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক ওই গোলরক্ষক, ‘ওদের একটু বুঝিয়ে উজ্জীবিত করতে পারলেই হলো। খুব ভালো খেলে। এমন সম্ভাবনা আরও অনেক আছে। শুধু তুলে আনা দরকার।’

বাফুফের সিলেট একাডেমি থেকে যেমন আবদুল্লাহ, সুফিল ও রবিউলকে দিলকুশায় নিয়ে আসেন নিজাম। অনূর্ধ্ব-১৬ সাফজয়ী দলের সদস্য ছিলেন এঁরা। আর তৃতীয় বিভাগ থেকে প্রিমিয়ারে ওঠার সিঁড়িটা পেতে দিয়েছেন দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাবের সভাপতি মমিনুল হক সাইদ। এই চারজনকে দিলকুশা থেকে সরাসরি আরামবাগে নিয়ে আসেন তিনিই।

কোচরা ঘষেমেজে এরপর তৈরি করলেন, আজ তো সবই গল্প। সেই গল্প প্রেরণা হতে পারে অন্যদের। এই খেলোয়াড়দের শ্রমে মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২৫ ম্যাচ খেলে আরামবাগের হার মাত্র পাঁচটি। লিগে ১৫ ম্যাচে ২০ পয়েন্ট। ১২ দলে ছয়ে অবস্থান। আরামবাগের পেছনে আছে মুক্তিযোদ্ধা, শেখ রাসেল, মোহামেডানের মতো নামী দলও।

আরও ভালো কিছুর আশায় ম্যাচ জিতলে ক্লাব সভাপতি গোটা দলকে বোনাস দেন লাখ টাকা। এভাবে অর্থের প্রবাহ বাড়ছে আবদুল্লাহদের জীবনে। বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁদের ওপর রয়েছে অন্য ক্লাবের দৃষ্টি। কিন্তু আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রস্তাব না মাথা ঘুরিয়ে দেয় এই খেলোয়াড়দের! বাংলাদেশে চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে যে সময় লাগে না!