‘আসসালামু আলাইকুম ভাই’, মাত্র তিন মাস আগে ঢাকায় পা রাখা এক আফগানের মুখে ‘ভাই’ শুনে একটু অবাকই হতে হলো। এরপর প্রশ্নটা শুনে আরেকটু, ‘বসার ঘর না শোবার ঘরে বসে কথা বলব?’ বাংলাদেশের সাধারণ আট-দশটা পরিবারে গিয়ে যে আতিথেয়তা পাওয়া যায়, গত রোববার দুপুরে ঢাকার সেগুনবাগিচায় ওমিদ পোপালজাইয়ের বাসায় গিয়েও একই অভিজ্ঞতা।

আসল অভিজ্ঞতাটা হলো অবশ্য একটু পরে। যখন চট্টগ্রাম আবাহনীর মিডফিল্ডার ওমিদ পোপালজাই শরণার্থী থেকে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প বলতে শুরু করলেন। শরণার্থীশিবিরে ১৪ বছর কাটিয়ে জাতীয় দলের ফুটবলার হওয়ার গল্প। আফগানিস্তানে প্রথমবারের মতো তালেবান-রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জীবন বাঁচাতে আফগানিস্তান ছেড়ে শরণার্থী হওয়া...সেই টালমাটাল জীবন থেকে উঠে এসে আবার মাতৃভূমির জার্সি গায়ে জড়ানো। জীবনের বাঁক বদলের গল্পগুলো বলার সময় বারবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন ওমিদ।

জীবনের গল্পটা বড় অদ্ভুত পোপালজাইয়ের
ফাইল ছবি

২৬ বছর বয়সী ওমিদের জন্ম কাবুলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। বাবা ইসমতউল্লাহ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সরকারি চাকরি করতেন। তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালে যখন কাবুল ছেড়ে রাশিয়ায় পাড়ি জমান, ওমিদ তখন ছোট্ট শিশু। রাশিয়ায় ঠাঁই না মেলায় পরবর্তী গন্তব্য জার্মানি। সেখানেও পাওয়া গেল না আশ্রয়। ২০০০ সালে ঠাঁই হলো নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রেভ নামক এক গ্রামের শরণার্থীশিবিরে। বিপত্তি পিছু ছাড়ল না। বাবা ইসমাতউল্লাহ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কাজ শিবিরে তাঁকে প্রতিপক্ষ গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে সন্দেহ করা হতো। যে কারণে পরিবারের সব সদস্য নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব পেলেও ওমিদের বাবা এখনো সেই ‘শরণার্থী’ পরিচয় নিয়েই বেঁচে আছেন।

ওমিদের ছেলেবেলার পৃথিবীটা ছিল অনেক ছোট। শরণার্থীদের আবার জীবন! নিজের দেশ থাকতেও ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে পরের দেশে গিয়ে একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজে নেওয়া। অনিশ্চিত জীবনের উত্তাল সাগরে গা ভাসিয়ে দিয়ে শুধু একটু খেয়েপরে বেঁচে থাকার আকুতি। ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য ছোট্ট দুটি কক্ষ। পুরো পরিবারের জন্য সপ্তাহে বরাদ্দ ছিল ১৫ ইউরো। অর্থাৎ, একেক জনের জন্য আড়াই ইউরো করে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪৩ টাকা)। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অন্য শরণার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রান্নাঘর ও শৌচাগার ব্যবহার করতে হতো। রক্তপাত দেখা ছিল নিত্য ব্যাপার। সাত বছর বয়সে এক চেচনিয়ানের হাতে কুর্দি বন্ধুর ছুরির আঘাতে মৃত্যুর দৃশ্যটা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় ওমিদকে। দুঃখের কালো ডায়েরি থেকে যেন তা পড়ে শোনালেন, ‘অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের। বিশেষ করে মা-বাবাকে। শরণার্থী জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমার কাছে এখন আর কোনো কিছুই ভয়ংকর মনে হয় না।’

শারনার্থী জীবন অনেক কিছুই শিখিয়েছে পোপালজাইকে
ফাইল ছবি
অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের। বিশেষ করে মা-বাবাকে। শরণার্থী জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমার কাছে এখন আর কোনো কিছুই ভয়ংকর মনে হয় না।
ওমিদ পোপালজাই, চট্টগ্রাম আবহানীর আফগান মিডফিল্ডার

দুমুঠো খেয়ে জীবন চালানোটাই ছিল অনেক কঠিন, সেখানে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তো অনেক দূরের বাতিঘর। হার না-মানা মানসিকতায় অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে লেখা হয়েছে ওমিদের জীবনের বাঁক বদলের গল্পগুলো। শিবিরে ফুটবল খেলার ব্যবস্থা ছিল। অন্যদের তুলনায় একটু ভালো খেলতেন বলেই নিরাপত্তারক্ষীদের অনুমতি নিয়ে শিবিরের পাশেই স্থানীয় একটি ক্লাবের মাঠে গিয়ে অনুশীলন করার সুযোগ হয়। সেখান থেকেই শুরু তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের।

২০১৫ সালে ১৮ বছর বয়সে নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বিভাগের একটি ক্লাবে খেলার মধ্য দিয়ে পেশাদার ফুটবলে পা রাখা। একই বছরে আফগানিস্তান ফুটবল ফেডারেশন জাতীয় দল গঠনের লক্ষ্যে জার্মানিতে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করলে, সেখানে নাম উঠিয়ে পেয়ে যান জাতীয় দলে খেলার টিকিটও। জাতীয় দলের জার্সিতে এখন পর্যন্ত ২৯ ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছেন ৫টি। দেশান্তরি হয়েও আফগানিস্তানের হয়ে খেলতে পারাটা ওমিদকে খুব আনন্দ দেয়, ‘দেশের হয়ে খেলতে পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব। জাতীয় দলে অভিষেকের দিন পুরো পরিবার আমার খেলা দেখার অপেক্ষায় ছিল।’

চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে খেলছেন পোপালজাই
ছবি: প্রথম আলো

ছোট বোনের বান্ধবী হাসিনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গত বছর ২২ নভেম্বর তাঁকে বিয়ে করেছেন। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা স্ত্রীকে নিয়েই এসেছেন বাংলাদেশে। আপাতত সঙ্গে আছেন শ্বশুরও। সেগুনবাগিচায় পাতা সে নতুন সংসারে অতীতের দুর্দশা ও বর্তমান আফগানিস্তানের গল্পই হয় বেশি।

আফগানিস্তানে আবারও ক্ষমতায় ফিরেছে তালেবান। তবে এবার আর শঙ্কিত নন ওমিদ, ‘আগের তালেবানের সঙ্গে এবারের তালেবানদের মেলানো যাবে না। এবার তারা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে অর্থনৈতিক সমস্যাও থাকবে না।’ আফগানিস্তানের মাটিতে জাতীয় দলের ক্যাম্প হলেও সেখানে যেতে কোনো সমস্যা নেই তাঁর। মাতৃভূমি ছাড়ার পর সেখানে মাত্র দুবার ফেরার সুযোগ হয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ওমিদ যেন আফগানিস্তানে ফেরার আশাতেই ব্যাকুল হয়ে থাকেন।