'একদিন আমিও নেইমার হমু'

এমন ​শিশুদের আনন্দের উপলক্ষ এনে দিল ফুটবল। ছবি: সৌজন্য
এমন ​শিশুদের আনন্দের উপলক্ষ এনে দিল ফুটবল। ছবি: সৌজন্য

পেশায় রাজমিস্ত্রি বাবা চান মিয়া ইদানীং কাজ করতে পারেন না। অসুস্থ বাবাকে ঘরে রেখে প্রতিদিন স্টেডিয়ামে ছুটে আসে সাইফুল ইসলাম। খেলতে নয়। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশের ফুটপাতে ভাত বিক্রি করা মাকে সাহায্য করতে। এর ফাঁকে স্টেডিয়ামের বলবয়ের কাজ করে। ম্যাচপ্রতি ১০০ টাকা পায়। অনেক সময় তা-ও মেলে না।
পল্টন আউটার স্টেডিয়ামে এমন সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়েই গতকাল শুরু হয়েছে পথশিশুদের ফুটবল টুর্নামেন্ট। আয়োজক ইলেকট্রনিকস পণ্যনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন।
এখানে খেলতে আসা ফুটবলারদের প্রায় সবার গল্পটাই সাইফুলের মতো। কেউ প্রেসবক্সে ফুট-ফরমাশ খাটে। কেউ বলবয়। কেউ বা স্টেডিয়ামে বাবার সঙ্গে চা বেচে। অনেকে রাস্তায় পরিত্যক্ত কাগজ বা প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায়। এসব পথশিশুর বিনোদনের বড় উপলক্ষ হয়ে এসেছে এই ফুটবল টুর্নামেন্ট। দুপুরের প্রখর রোদ। পায়ের নিচে তপ্ত বালু। কিন্তু সব যেন থোড়াই কেয়ার! মহা আনন্দে চলছে ফুটবল খেলা।
বছর তিনেক আগে সাইফুল যখন বাবার হাত ধরে সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিল, তখন স্টেডিয়ামই চিনত না। মায়ের সঙ্গেই একদিন স্টেডিয়ামে এসেছিল। মাকে উঁচু ফ্লাডলাইটগুলো দেখিয়ে বলেছিল, ‘মা, এত্ত বড় বাতি জ্বালিয়ে কী হয় এখানে!’ মা হেসে বলেছিলেন, ‘ওইটা স্টেডিয়াম, ওইখানে খেলা হয়।’ গ্রামের মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো সাইফুল ঢাকায় এসে সুযোগ খুঁজত খেলার। একদিন মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে পরিচয় হয় আরেক পথশিশু আবদুর রহমানের সঙ্গে। রহমান প্রায়ই সাইফুলের মায়ের কাছে ভাত খেতে আসত। রহমানই তাকে পাইওনিয়ারের একটি ক্লাবে নিয়ে যায়। স্থানীয় একটি টুর্নামেন্টে খেলে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও পেয়েছে সাইফুল। খেলার নেশাটা এতই যে, রাত জেগে ফুটবল ম্যাচ দেখে। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড নেইমারের খেলা থাকলে তো কথাই নেই। পরশু লা লিগায় রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে বার্সেলোনার ম্যাচটিও দেখেছে সে। দেখেছে নেইমারের ভয়ংকর রূপ, হ্যাটট্রিকের মনোমুগ্ধকর উদ্‌যাপন। প্রিয় খেলোয়াড়ের প্রসঙ্গ তুলতেই সাইফুলের চোখে-মুখে বয়ে গেল খুশির জোয়ার। পল্টন মাঠে খেলছে সাইফুল, কিন্তু স্বপ্নের পরিধি যেন আকাশছোঁয়া। অবলীলায় বলে ফেলল, ‘একদিন আমিও নেইমার হমু।’ সাইফলু সেটা হতে পারুক আর না পারুক, সেই স্বপ্নটা তো দেখছে। মানুষ তো তার আশার সমান বড়, স্বপ্নের সমান বড়।

রিয়াজ হাওলাদারের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বিআরটিসি বাসের টিকিট বিক্রেতা। ছেলেকে বড় ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন দেখেন বলেই রিয়াজকে ভর্তি করে দিয়েছেন আরামবাগ ফুটবল একাডেমিতে। বলবয় রিয়াজ পথশিশুদের টুর্নামেন্টে খেলার আগে খেলেছে পাইওনিয়ারে। পল্টনে ভরদুপুরের রোদের মধ্যে খেলতেও কোনো কষ্ট হচ্ছে না তার, ‘স্টেডিয়ামে শুধু বল টোকাই। কিন্তু খেলতে পারি না। এখানে আমরা খেলতে পারছি, কী যে আনন্দ লাগছে!’
স্টেডিয়ামের টং দোকানদার বেলাল হোসেন টুর্নামেন্টের নাইন স্টার ক্লাবটির সংগঠক। স্টেডিয়ামের আশপাশের বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের তিনিই ডেকে এনেছেন খেলতে। নিজের ছেলে চাঁদ হোসেনকেও সুযোগ দিয়েছেন।
এক দিন দোকানে না গেলে, সেদিনের বেতন কাটা যাবে-তারপরও খেলার মাঠে ছুটে এসেছে মোহাম্মদ পলাশ। গাউসিয়ার কাপড়ের দোকানের কর্মচারী স্বপ্ন দেখে একদিন জাতীয় দলের গোলরক্ষক হবে, ‘ফরাশগঞ্জের গোলকিপার সুজন ভাই একদিন আমার খেলা দেখেছিল। আমি একটা পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর বলেছিল, তুই খেলাটা ছাড়িস না।’ কিন্তু চাইলেই তো আর নিয়মিত খেলতে পারে না পলাশরা। কামরাঙ্গীরচরে বাবা খলিল তালুকদারের ছোট মুদির দোকান আছে। বাবার একার আয়ে সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়েই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে পলাশের। বাবা তাকে দোকানে কাজে পাঠিয়েছেন। কাপড়ের দোকানে কাজ করলেও পলাশের মন পড়ে থাকে মাঠে, ‘মঙ্গলবারে সাপ্তাহিক ছুটি পাই। ওই দিনই বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলি। আজ মালিককে বলে ছুটি নিয়েছি।’
আয়োজক ওয়ালটনের কর্মকর্তা এফ এম ইকবাল বিন আনোয়ার এমন উদ্যোগটা ছড়িয়ে দিতে চান সারা দেশে, ‘শুধু ঢাকায় না, আমরা সব বিভাগীয় শহরে খেলাটার আয়োজন করতে চাই। তাহলে দেশের সুবিধাবঞ্চিত এই পথশিশুরা মাদকের নেশা থেকে কিছুটা সময় হলেও দূরে সরে থাকবে। কর্মজীবী ছেলেরা একটু হলেও পাবে নির্মল বিনোদন।’
অভাব ওদের নিত্যসঙ্গী। বিনোদন ওদের বিলাসিতা। পথের ধারের ‘নামহারা ফুল’ এসব শিশু-কিশোরের কাছে টুর্নামেন্টটা যেন এক টুকরো ঈদ উৎসব। খেলার ফাঁকে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। তালে তালে নাচছে সবাই। কে বলবে, এদের জীবনে আনন্দ নেই!