কাবাডিতে বদলে গেছে তাঁদের জীবন
স্ত্রী আর পাঁচ সন্তানের সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন মাসুদ করিমের কৃষক বাবা ফজলুর রহমান। বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড় মাসুদ সংসারের সেই অসচ্ছলতা দূর করেছেন কাবাডি খেলেই।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বাড়িতে টিনের ঘরের জায়গায় উঠেছে পাকা দালান। ময়মনসিংহ শহরে জমি কিনেছেন। ছোট ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন। সেই ভাই এখন পুলিশে চাকরি করেন। শুধু মাসুদ নন, কাবাডি বদলে দিয়েছে জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক তুহিন তরফদার ও জিয়াউর রহমানের পরিবারের জীবনও।
ভারতের প্রো-কাবাডিতে এবার বাংলাদেশ থেকে খেলবেন এই তিন খেলোয়াড়। ইউপি যোদ্ধায় খেলবেন মাসুদ ও জিয়াউর। তুহিনকে কিনেছে তামিল তালাইভাস। প্রো-কাবাডিতে তৃতীয় মৌসুম খেলবেন জিয়াউর ও মাসুদ, দ্বিতীয়বার তুহিন। ২০১৬ সালে ভারতে হওয়া কাবাডি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন জিয়াউর ও তুহিন। সে পারফরম্যান্স দেখেই ২০১৭ সালের প্রো-কাবাডিতে তাঁদের দলে নেয় ইউপি যোদ্ধা ও তামিল তালাইভাস। সেবার জিয়াউর রহমান পেয়েছিলেন ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এক ম্যাচে সেরা হয়ে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন মোটরসাইকেলও। পরের মৌসুমেই জিয়াউরের দাম যায় আরও বেড়ে। বেঙ্গল ওয়ারিয়র্স তাঁকে কিনে নেয় ৩৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকায়।
তুহিন অবশ্য সে তুলনায় প্রো-কাবাডি থেকে কমই আয় করেছেন। ২০১৭ সালে পেয়েছেন ১২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে তামিল তালাইভাস তাঁকে নিলেও খেলতে যাননি চোটের কারণে। এবারও তুহিনকে ১২ লাখ টাকায় কিনেছে তালাইভাস।
তুহিনের আয় মূলত খেপ খেলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খেপ খেলতেন। এলাকার সবাই ডাকতেন ‘খেপ মাস্টার’ বলে। দেশের ৫৫টি জেলায় খেপের টুর্নামেন্টে খেলেছেন তুহিন। সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন কতবার, হিসাব নেই! পুরস্কার হিসেবে অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোনই জিতেছেন ১৫টি। এ ছাড়া ফাউন্টেন কলম, হাতঘড়ি, দেয়ালঘড়ি, ডিভিডি প্লেয়ার, ফুলদানি তো আছেই। কাবাডি খেলার সুবাদেই তুহিনের চাকরি হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে।
সেদিন পল্টন কাবাডি স্টেডিয়ামে বসে খেলা থেকে নিজের আয়ের কথা বলছিলেন তুহিন, ‘প্রো-কাবাডি ছাড়া শুধু খেপ খেলেই এ পর্যন্ত আয় করেছি ৪০ লাখ টাকার মতো। খেলোয়াড় হিসেবে চাকরি করে ব্যাংকে জমিয়েছি আরও ৪০ লাখ।’
খেপের টুর্নামেন্টে তুহিনের মূল্য আকাশচুম্বী। অথচ ক্যারিয়ারের প্রথম খেপের টুর্নামেন্টে পেয়েছিলেন মাত্র ২০ টাকা! শুরুতে বাগেরহাটের কচুয়ায় নিজ গ্রামে খেলতেন। এরপর আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও জেলায় নাম ছড়িয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় এক টুর্নামেন্টে খেলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়ার রেকর্ড আছে তাঁর।
বাংলাদেশ পুলিশের খেলোয়াড় মাসুদ। চাকরিতে ঢোকার আগে খেলাধুলাই করেননি। খেলতে গিয়ে হাত-পা ভেঙে যেতে পারে, সেই আশঙ্কায় মা–বাবা ফুটবলে লাথি দিতেও নিষেধ করতেন। সেই মাসুদকেই বদলে দিয়েছে কাবাডি। মাসুদ বলছিলেন, ‘২০০৮ সালে পুলিশে যোগ দিই। আমার উচ্চতা দেখে পুলিশ দলের সাবেক কোচ আশরাফুল দুলু স্যার কাবাডি দলে নিয়ে আসেন।’ আন্তবাহিনীর টুর্নামেন্টে ভালো করায় ডাক পান ২০১৪ সালের এশিয়ান গেমসের দলে। অথচ তখনো পরিবারের লোকজন জানতেন না মাসুদের খেলোয়াড়ি পরিচয়, ‘টিভিতে জাতীয় দলের তালিকায় আমার নাম দেখে প্রথমবার মা–বাবা জানতে পারেন, আমি কাবাডি খেলি।’
ইউপি যোদ্ধায় প্রথম মৌসুমে মাসুদ পেয়েছিলেন সাড়ে ১১ লাখ টাকা। এরপর কোয়ালিফাই ম্যাচ জেতার সুবাদে পান আরও পাঁচ লাখ। পরের দুই মৌসুমেও তাঁকে একই দামে কিনেছে দলটি। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে আইজিপি কাপ ও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে গত পাঁচ বছর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছেন অনেক আর্থিক পুরস্কার।
জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড়েরা কোনো না কোনো সার্ভিসেস সংস্থায় চাকরি করেন। প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলার অনুমতি নেই তাঁদের। কাবাডি খেলে বাড়তি আয়েরও তাই সুযোগ খুব কম। প্রো-কাবাডি আর খেপ খেলার সুবাদে এই দিক দিয়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এই তিনজন।
জিয়াউর অবশ্য পেশাদার কাবাডি লিগেই দেখছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, ‘নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে প্রো-কাবাডি খেলছি শুধুই আর্থিক সচ্ছলতার জন্য। যদি আমাদের দেশেও এমন কাবাডি লিগ হতো, তাহলে দেশের কাবাডির চেহারাটাই বদলে যেত।’