গণিতবিদের সোনা জয়ে ফিরল ১২৫ বছর আগের ইতিহাস

মেয়েদের সাইক্লিং রোড রেসে সোনাজয়ী আনা কিসেনহোফেরছবি: রয়টার্স

অলিম্পিক সাইক্লিং রোড রেস। প্যাডেল চাপছেন প্রাণপণে, সামনেই ফিনিশিং লাইন। সেই সীমারেখা পেরিয়ে মুখে ফুটল সীমা ছাড়ানো সোনা জয়ের হাসি। কিন্তু ভুল ভাঙল মুহূর্তখানেক পরই।

আসলে রেস শেষ করেছেন—প্রথম হওয়া প্রতিযোগীর চেয়ে মিনিটখানেক ব্যবধানে পিছিয়ে।

নেদারল্যান্ডসের তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অ্যানেমিক ফন ভ্লিউটেনের জন্য এই দৃশ্য কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। রোববার অলিম্পিকে মেয়েদের সাইক্লিং রোড রেসে ভ্লিউটেন এক অঙ্কের পিএইচডি ডিগ্রিধারীর কাছে সোনা হারান ঠিক এই ভুলে।

বেচারা ভ্লিউটেন! ডাচরা এই ইভেন্টে ফেবারিট ছিলেন। ভ্লিউটেনসহ আরও তিনজন নিয়ে বানানো ডাচ ‘কোয়ার্ট্রেট’ এই ইভেন্টে নামার আগে সবাই মিলে নয়বার জিতেছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব এবং শেষ দুটি অলিম্পিক সোনা।

আনা কিসেনহোফেরকে তাঁরা ভুলবেন কীভাবে? মাউন্ট ফুজির বুক চিরে তিনি যে রূপকথা লিখেছেন!

অলিম্পিকে রুপার পদক কম নয়। ভ্লিউটেনের তবু বেজার মুখ। কে ভেবেছে, ৩০ বছর বয়সী এক অখ্যাত সাইক্লিস্ট রেসের শুরু থেকে সব প্রতিযোগীকে এত দূরত্বে পেছনে ফেলবেন যে প্রায় সবাই ভুলে যাবেন সামনে কেউ আছে!

ফিনিশিং লাইন পেরোনোর পর আনা কিসেনহোফের
ছবি: রয়টার্স

কিসেনহোফের ঠিক এভাবেই বাকিদের পেছনে ফেলে অলিম্পিক রোড রেসের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছেন সবচেয়ে বড় অঘটনের। ব্রিটিশ সাইক্লিস্ট লিজি ডেইগানের মতো অনেকেই শুরুতে ভেবেছিলেন ভ্লিউটেন চ্যাম্পিয়ন।

কিন্তু খেলাধুলা মানেই তো প্রতিনিয়ত ভাবনার সীমারেখাকে চ্যালেঞ্জ জানানো—অলিম্পিক যেন তার শীর্ষ বিন্দু।

১৩৭ কিলোমিটার দূরত্বের এই রেসে শুরুতে ১০ মিনিট ব্যবধানে এগিয়ে যান কিসেনহোফের। মাউন্ট ফুজি ইন্টারন্যাশনাল স্পিডওয়ের ওপর দিয়ে তিনি এগিয়ে যাওয়ার সময়ও প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ছিল ফিনিশিং লাইন।

ভ্লিউটেন এই দূরত্ব পেয়েও তাঁকে ধরতে পারেননি। ৭৫ সেকেন্ড সময় ব্যবধানে এই ইভেন্টের ‘হট ফেবারিট’কে পেছনে ফেলেন কিসেনহোফের। এই ইভেন্টের জন্য তাঁর কোনো কোচ ছিল না, অনুশীলন করেননি কোনো পেশাদার দলের সঙ্গে।

পদক জিততে পারেন, এই অনুমানের ধারেকাছেও ছিলেন না। তবু অলিম্পিক অভিষেকে সাইক্লিং ইভেন্টে গত ১২৫ বছরের মধ্যে তিনি প্রথম সোনা এনে দিয়েছেন অস্ট্রিয়াকে। সেটাও কোনো দল ছাড়া, একাই! ১৮৯৬ এথেন্স অলিম্পিকে সাইক্লিংয়ে অস্ট্রিয়ার হয়ে সর্বশেষ সোনা জিতেছিলেন অ্যাডল শ্যামার।

ফিনিশিং লাইন পেরোচ্ছেন কিসেনহোফের। শেষ করলেন এক দুর্দান্ত অভিযাত্রা
ছবি: রয়টার্স

কিসেনহোফের ঠিক কতটা পথ এগিয়ে ছিলেন, ভ্লিউটেন এবং তাঁর বাকি সতীর্থরা বুঝতে পারেননি। হিসেবে এই ভুলের কথা পরে তাঁরা স্বীকার করেন। অন্যদিকে কিসেনহোফেরের হিসাব ছিল সোজাসাপ্টা, ‘এসব হিসাব–নিকাশের জন্য তো উচ্চতর গণিতের দরকার নেই। মনের ইচ্ছাটাই আসল। এই রেস নিয়ে আমার পরিকল্পনা ছিল, কখন কোথায় কতটা পথ এগোতে হবে, কতটুকু খাবার নিতে হবে—এসব ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত সবার আগে রেস শেষ করতে পেরে ভালো লাগছে।’

অস্ট্রিয়ান সাইক্লিংয়ে কিসেনহোফের টাইম ট্রায়াল চ্যাম্পিয়ন। খেলেছেন ট্রায়াথলনও। কিন্তু অলিম্পিক অভিষেকে এই প্রতিযোগিতায় তাঁকে কেউ ফেবারিটের চোখে দেখেনি।

কিসেনহোফের নিজেও কিন্তু ভেবেছিলেন, বাকিদের মধ্যে যেহেতু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় চ্যাম্পিয়নরা আছেন; তিনি পাত্তাই পাবেন না! কিন্তু দেখা গেল, ৮৫ মাইলের দূরত্বে ফুজির উঁচু–নিচু খাত বেয়ে কিসেনহোফের যখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, বাকিদের পাত্তা নেই।

শেষ ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে কিসেনহোফেরকে কেউ ধরতে পারেননি
ছবি: রয়টার্স

ব্রিটেনের সাবেক সাইক্লিস্ট ও অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ক্রিস বোর্ডমান বিবিসিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় বলেছেন, ১০০০–১ বাজির দরের বিপরীতে রেস জিতেছেন এই অস্ট্রিয়ান—যিনি গণিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং সুইজারল্যান্ডে লুইজিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকও।

সাইক্লিংয়ে সাধারণত রেস শুরুর পর একটা নির্দিষ্ট সময় বা দূরত্ব পর্যন্ত ‘দল’ (পেলোটন) হিসেবে সাইকেল চালান প্রতিযোগীরা। একে অপরের কাছাকাছি দূরত্বে থেকে প্যাডেল চেপে তাঁরা শক্তি সংরক্ষণ করেন। অনেকে এই ‘পেলোটন’ ছেড়ে বেরিয়ে যান, এগিয়ে যান আরও সামনে।

কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, পেলোটনের দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাইক্লিস্টরা তাঁদের ধরে ফেলেন এবং শেষ পর্যন্ত সঞ্চয়কৃত শক্তির বলে তাঁদের ভেতর থেকেই কেউ না কেউ চ্যাম্পিয়ন হন।

মজার বিষয়, কিসেনহোফের সাইক্লিংয়ের এই সর্বজনস্বীকৃত কৌশলকেও ভুল প্রমাণ করেছেন, রেসের শুরু থেকে এগিয়ে গিয়ে এবং সবার আগে রেস শেষ করে।

রোড রেসে সাধারণত সাইক্লিস্টদের সঙ্গে প্রযুক্তিও থাকে। কানে হেডফোন নিয়ে নিজের দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। কে, কত দূর এগিয়ে গেল, কত দূর যেতে হবে, কতটা দ্রুত গেলে সামনের প্রতিযোগীকে ধরা যাবে—এসব আরকি।

সবার সামনে কিসেনহোফের। সবার সামনে থেকেই রেস শেষ করেন তিনি
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু অলিম্পিকে সাইক্লিংয়ের রোড রেসে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম নেই। সাইক্লিস্টদের সঙ্গে থাকা মোটরবাইকারদের কাছ থেকে সময়ের হিসাব পেতে হয়। ডাচদের দলটা ঠিক এখানেই ভুলটা করে। ভ্লিউটেনের ফিনিশিং লাইন শেষ করে আনন্দে ফেটে পড়াটা সে জন্যই।

অবশ্য আরেকটি কারণও আছে—টোকিও অলিম্পিকে সোনা জয় ভীষণ প্রার্থিত ছিল তাঁর কাছে। ২০১৬ অলিম্পিকে রোড রেসে সবার সামনে থেকেও এক দুর্ঘটনায় তাঁর রাত কেটেছিল হাসপাতালে। সোনা এবারও অধরা রইল!

এদিকে এই সোনার পদক যাঁর হাতে ধরা দিয়েছে, সেই কিসেনহোফের রেসের শেষ ৪০ কিলোমিটার একাই শেষ করার পথে জানিয়েছেন নিজের অবিশ্বাস্য সব ভাবনার কথা।

তখন কিছুটা ভাবাবেগ পেয়ে বসেছিল তাঁর। ভাবছিলেন পরিবারের সদস্যদের কথা। এই পথ পর্যন্ত উঠে আসতে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে কতটা সাহায্য করেছে, ‘পরিবারের কথা ভাবছিলাম। মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। জানতাম, ওরা দেখছে। সাবেক কোচ ও কিছু বন্ধুর মুখও চোখে ভেসেছে।’

বিজয়মঞ্চে সবার ওপরে কিসেনহোফের
ছবি: এএফপি

অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার আগে ২০১৭ সাল থেকে কোনো পেশাদার সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে অনুশীলন করেননি কিসেনহোফের। এটা নাকি তাঁর চরিত্রের সঙ্গে ঠিক যায় না, ‘আমি স্বাধীনচেতা। নিজেই নিজের অনুশীলনসূচি ও রেস ঠিক করতে ভালোবাসি, নিঃসঙ্গ যোদ্ধার মতো।’

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার ডিগ্রি অর্জনের পর কাতালোনিয়া পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবহারিক গণিতে পিএইচডি করেন এই সাইক্লিস্ট।

রেস পরিকল্পনা, পুস্টির জোগান কেমন ও কতটুকু হবে—এসব কিসেনহোফের নিজেই ঠিক করেন। এই প্রেরণা তিনি নিয়েছেন গণিত থেকে, ‘গণিতবিদদের কিন্তু একাই সমস্যা সমাধান করতে হয়। সাইক্লিংয়ে এটা প্রয়োগ করেছি। অনেকেই কিন্তু এসব কাজের জন্য লোকবল নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমি এমন নই, একটু আলাদা হয়ে থাকাই আমার পছন্দ। পাদপ্রদীপের আলো ভালো লাগে না।’

আলাদা–ই তো! শেষ ৪০ কিলোমিটারে এসেও যে কিসেনহোফেরকে কেউ ধরতে পারেনি!