বাংলাদেশের অলিম্পিক–ভ্রমণ শেষ, ব্যর্থতার দায় কি কেবল ক্রীড়াবিদদের

অলিম্পিক কি কেবল ভ্রমণই বাংলাদেশের কাছে?ছবি: রয়টার্স

হতাশায় শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের আরেকটি অলিম্পিক। আজ সকালে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে ছেলেদের ৪০০ মিটার হিটে জহির রায়হান হয়েছেন ৪৭ জনের মধ্যে ৪৪তম। নিজের ক্যারিয়ার–সেরা টাইমিংটাও করতে পারেননি জহির। ৪৮.২৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে আটজনের মধ্যে অষ্টম হয়ে শেষ করেছেন হিট।

কেমন কাটল বাংলাদেশের টোকিও অলিম্পিক? এককথায় বলা যায়, বরাবরের মতোই খালি হাতে দেশে ফেরা খেলোয়াড়দের। যদিও এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয় বাংলাদেশের জন্য। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা ব্যর্থতার গল্পটাই যেন নতুন করে শোনা গেল টোকিওতে।

অলিম্পিকে এই লাল–সবুজ পতাকা কবে গর্বের সঙ্গে উড়বে?
ছবি: রয়টার্স

এই ব্যর্থতায় দোষ কি খেলোয়াড়দের দেওয়া যায়! যে দেশের কাছে অলিম্পিক ‘বেড়ানো’ আর ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন নামের এক বায়বীয় লক্ষ্যের ক্ষেত্র, সেখানে খেলোয়াড়দের দোষ দিয়ে কী লাভ! বছরের পর বছর অলিম্পিকে গিয়ে ‘আমরা এবার অনেক শিখেছি’জাতীয় বুলি আউড়ে চলেছেন আমাদের ক্রীড়াজগতের মানুষেরা। অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতায় সফল হতে কী কী করা দরকার, এসব যেন মাথায় নেই তাঁদের। সুন্দর পরিকল্পনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। যেভাবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন চলছে, তাতে ক্রীড়াবিদেরা যে অলিম্পিকের মতো আসরে সাহস করে দাঁড়াতে পারছেন, সেটিই তো অনেক বড় ব্যাপার।

অ্যাথলেটিকসের কথাই ধরুন। ঘরোয়া অ্যাথলেটিসকের রুগ্‌ণ অবস্থা বরাবরের মতোই রয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ঘাসের ট্র্যাকে জাতীয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করছে ফেডারেশন। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে একটা অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক আছে বটে, কিন্তু সেটা যেন বাংলাদেশের দৈন্য অ্যাথলেটিকসেরই প্রতীক। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৬ সালে বসানো এই ট্র্যাকের জীবনশক্তি শেষের পথে। বিভিন্ন জায়গায় টার্ফ ছেঁড়া, গর্ত হয়ে আছে। এখানেই বছরের পর বছর চলে সামার, বয়সভিত্তিক ও জাতীয় অ্যাথলেটিকস। বৃষ্টিতে ট্র্যাকের ছোটখাটো গর্তে প্রায়ই পানি জমে।

ব্যর্থতার মধ্যেও রোমান সানা কিছুটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর্চারিতে
ছবি: রয়টার্স

ফেডারেশনে নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। অলিম্পিক দূরে থাক, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার প্রথম বড় আসর এসএ গেমসেই তো অ্যাথলেটিকসের কোনো ইভেন্ট থেকে সোনা জেতে না ১৫ বছর! সর্বশেষ ২০০৬ কলম্বো এসএ গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে সোনা জিতেছিলেন মাহফুজুর রহমান। কর্মকর্তা কিংবা অ্যাথলেট—কারোরই যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই।

সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পান না এ দেশের অ্যাথলেটরা। টোকিও যাওয়ার এক মাস আগেও তাই জহির জানতেন না তিনিই যাবেন অলিম্পিকে! দেশের দুই দ্রুততম মানব-মানবী মোহাম্মদ ইসমাইল ও শিরিন আক্তারকে অনেকটা উপেক্ষা করেই জহিরকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফেডারেশন। ইসমাইল বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে (বিওএ) সিদ্ধান্তটা পুনর্বিবেচনারও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ট্র্যাকের বেহাল দশা, এর মধ্যেই অনুশীলন করেন অ্যাথলেটরা
ছবি: শামসুল হক

এবার আসা যাক শুটিংয়ে। দেশের সেরা শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকিকে টানা দ্বিতীয়বার পাঠানো হলো অলিম্পিকে। কিন্তু ছেলেদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে বাকি ৬১৯.৮ স্কোর করে ৪৭ জনের মধ্যে হয়েছেন ৪১তম। জহিরের মতোই তলানির দিকে খুঁজে পাওয়া গেল বাকিকে! অন্তত রিও অলিম্পিকের স্কোরও যদি বাকি করতেন, সেটাও সান্ত্বনা থাকত তাঁর। ২০১৬ সালে রিওতে বাকি ৬২১.২ স্কোর করেছিলেন, হয়েছিলেন ৫০ জনের মধ্যে ২৫তম। পারফরম্যান্সের গ্রাফ শুধু নিচের দিকেই নামছে বাকির।

শুটিংয়ের এই ব্যর্থতার পুরো দায় বাকির ওপর চাপিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারবেন কি শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মকর্তারা? একদমই না। শুটিংয়ে যিনি টোকিও অলিম্পিকের স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন, সেই ডেনমার্কের কোচ ক্লাভস ক্রিস্টিয়েনসেনকে তিন বছর আগেই তাড়িয়ে দিয়েছে ফেডারেশন। চেয়ার দখলের লড়াইয়ে মাঝে কিছুদিন ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদের দ্বন্দ্বটা তুমুলে ওঠে। পাইপলাইনে নতুন শুটার নেই বললেই চলে। ছেলে ও মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে একসময়ের স্বর্ণপ্রসবা বাংলাদেশ এখন অতীতের ছায়া হয়ে আছে। ২০১৬ এসএ গেমসের পর থেকে যেখানে এসএ গেমসে শুটিংয়ে কোনো সোনা জেতে না বাংলাদেশ, সেখানে অলিম্পিকে ভালো কিছু করার আশাও যেন বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো অবস্থা।

সীমিত সুযোগ–সুবিধার মধ্যেই নিজেদের তৈরি করতে হয় ক্রীড়াবিদদের।
ছবি: প্রথম আলো

সাঁতারেও একই চিত্র টোকিও অলিম্পিকে। আরিফুল ইসলাম ও জুনায়না আহমেদ যদিও নিজেদের ক্যারিয়ার–সেরা টাইমিং করেছেন ৫০ মিটার ফ্রি–স্টাইলে, কিন্তু আরিফুল হয়েছেন ৭৩ জনের মধ্যে ৫১তম। জুনায়না ৮১ জনের মধ্যে ৬৮তম। আরিফুল ফ্রান্সে ও জুনায়না লন্ডনে নিয়মিত অনুশীলনে থেকেই টাইমিংয়ে যেটুকু উন্নতি করেছেন। অলিম্পিকের পদক পাওয়ার আশা এই সাঁতারুরা কখনোই করেন না। কিন্তু তাঁদের ঘিরে এমনকি এসএ গেমসের কোনো পরিকল্পনাও নেই সাঁতার ফেডারেশনের। তাই অলিম্পিক থেকে নিয়ে আসা অভিজ্ঞতাটাই হয়তো পরের কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজে লাগাতে চাইবেন এই দুজন।

পুরো অলিম্পিকে শুধু আর্চারিই বাছাই পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন। মিশ্র ইভেন্টের নকআউটে যদিও হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ১৬ দলে হয়েছে নবম। রোমান হেরেছেন এককের দ্বিতীয় রাউন্ডে, দিয়া প্রথম রাউন্ডে। কিন্তু দুজনেরই ১ পয়েন্টের হারের আক্ষেপটা হয়তো ভবিষ্যতে স্বপ্ন দেখাচ্ছে আর্চারিকে।

অলিম্পিকে অংশগ্রহণ শেষে খেলোয়াড়দের নিয়ে দেশে ফিরবেন কর্মকর্তারা। অন্য দেশের অ্যাথলেটরা কীভাবে বিজয়মঞ্চে উঠে হেসেছেন, তা দেখে তাঁরা হয়তো আফসোস করেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই উন্নত প্রশিক্ষণ ও ভালো সুযোগ–সুবিধা দিয়ে অ্যাথলেটদের পদকমঞ্চে ওঠানোর কাজটা করার সময় কি এবার হবে তাঁদের?