‘মীরাবাই’ হতে রোমানের পাশে থাকবে বাংলাদেশ?

তিরন্দাজ রোমান সানা। ফাইল ছবি

ক্রিকেটের ২২ গজে মুঠো ফসকে জয় হারানোর বেদনা অনেকবারই পেয়েছে বাংলাদেশ। ফুটবলেও শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে কতবার! হয়েছে স্বপ্নের সমাধি। এবার অলিম্পিকের মঞ্চে তেমনই একটা আক্ষেপের গল্প শোনালেন তিরন্দাজ রোমান সানা।

রোমানকে নিয়ে একটা আশা ছিল—তিনি ভালো করবেন। কিন্তু অতি আশাবাদী ছিলেন না কেউই। বাংলাদেশের এ তিরন্দাজ প্রথমবারেই অলিম্পিকের অধরা পদক এনে দেবেন, এমনটা কেউই ভাবেননি। কিন্তু তাঁকে ঘিরে তো একটু আশার সলতে রোমান নিজেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করে চলেছেন রোমান, তাতে অলিম্পিক ঘিরে ‘ভালো কিছু’র স্বপ্নটা জাগছিল।

রোমানের স্বপ্নযাত্রার শুরুটা বেশ ভালোই হয়েছিল। নকআউট পর্বের প্রথম রাউন্ডে গ্রেট ব্রিটেনের টম হলকে হারিয়ে দেন। কিন্তু কানাডার ক্রিসপিন ডুয়েনাসের কাছে যেভাবে শেষ শটে গিয়ে মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য হারলেন, সেই আক্ষেপ নিশ্চিত করেই অনেক দিন পোড়াবে রোমানকে।

এবার আসা যাক অলিম্পিকে বাংলাদেশের ব্যর্থতার প্রসঙ্গে। পাশের দেশ ভারতও এবার অলিম্পিকে পদক জিতেছে। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে তো একাধিক পদকই এসেছিল তাদের। ভারতকে অলিম্পিকের পোডিয়ামে দেখে আক্ষেপটা হয় সবার। বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের আক্ষেপটা অবশ্যই আরও বেশি। তাঁরাও তো স্বপ্ন দেখতে চান। দেশের পতাকা ওড়াতে চান অলিম্পিকের বিশ্বমঞ্চে।

স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রোমান
ছবি: টুইটার

এবারের টোকিও অলিম্পিকে ভারোত্তোলক মীরাবাই চানু ভারতকে এনে দিয়েছেন রুপার পদক। অথচ মীরাবাই ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ফিরেছিলেন খালি হাতে। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে তিনবারের একবারও ভার তুলতে পারেননি। সেই মীরাবাই কিন্তু টানা অনুশীলন চালিয়ে গেছেন পরের পাঁচ বছর এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েই ফিরেছেন ভারতে। প্রশ্নটা হচ্ছে, এক শটের আক্ষেপের পর কি ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিকে আবারও সুযোগ পাবেন রোমান? পরের অলিম্পিকের জন্য কি টানা অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা পাবেন তিনি? প্রয়োজনীয় সহায়তা কি পাবেন এই তিরন্দাজ?

রোমান স্বপ্নটাকে বড় করতে পারবেন আগামীতে?
ছবি: টুইটার

সেই ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে প্রথম অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর নয়টি অলিম্পিক গেমসে ছিলেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। কিন্তু এর আগে কোনো অ্যাথলেট কি একটাবারের জন্যও বাছাইপর্ব পার হতে পেরেছেন? হিটেই বাদ পড়াটা ছিল তাঁদের কপালের লেখন। পত্রপত্রিকার পাতায় অলিম্পিক ভরাডুবির খবর পড়তে পড়তে অলক্ষ্যে দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরাও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এমনটা হতে হতেই বাংলাদেশ ঢুকে গেছে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ অথচ অলিম্পিকে একবারও পদক পায়নি, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত তালিকা। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে চলে দেদার হাসাহাসি। সত্যিই তো ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ, এ দেশ অলিম্পিকে মাথা উঁচু করে লড়ার মতো একজনও ক্রীড়াবিদ তৈরি করতে পারে না! রোমানই প্রথমবারের মতো এবার অলিম্পিকে গিয়েছিলেন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে, পুরোপুরি নিজের যোগ্যতায়। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিকের ‘বাছাইপর্বে’র বাধা ডিঙিয়ে খেলেছেন চূড়ান্ত পর্বে। প্রথমে আর্চারির মিশ্র ইভেন্টে দিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে হারলেও হেরেছেন সোনাজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। কিন্তু নজরকাড়া পারফরম্যান্সে সবার মন জয় করেছেন।

সেই ধারাবাহিকতায় রিকার্ভের ব্যক্তিগত একক ইভেন্টে রোমান এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভালোভাবেই। রোমান যদি শেষ ষোলোতে উঠতে পারতেন, ডুয়েনাসকে হারিয়ে তা হতো অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য আরও বড় ইতিহাস। এর আগে যে এ পর্যন্তও কেউ পৌঁছাতে পারেননি!

এবারের অ্যাথলেট দলের সঙ্গে টোকিওতে গেছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান। যদিও তিনি আয়োজক জাপান অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে গেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা, বিওএর মহাব্যবস্থাপক ফখরুদ্দিন হায়দার, শেফ দ্য মিশন বিওএর সহসভাপতি শেখ বশির আহমেদ, আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিওএর কোষাধ্যক্ষ কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব, সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা বদরুল সাইফ, সাঁতারের কোচ হিসেবে গেছেন আরেক কর্মকর্তা নিবেদিতা দাস।

বাংলাদেশের দুই আর্চার রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী।
ছবি: টুইটার

প্রতিবার অলিম্পিক গেমস এলেই কোনো না কোনো ক্রীড়া সংগঠক দলের সফরসঙ্গী হবেন। কেউ প্রয়োজনে, কেউ অপ্রয়োজনে। কিন্তু এই কর্মকর্তারা তো অলিম্পিক গেমস ঘুরে আসার পর বুঝতে পারেন, কোথায় বাংলাদেশের দৈন্য। পদক জিততে সত্যিই কোথায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ?

যেখানে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের সোনা জিততে ঘাম ছুটে যায়, সেখানে অলিম্পিক তো দূর আকাশের তারা। অথচ এসএ গেমসের পাশাপাশি এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসের মতো বড় আন্তর্জাতিক আসরে নিয়মিতই অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বিওএ এবং বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের কর্মকর্তারা গেমস থেকে ফেরেন, কিন্তু ফেরার পর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যই যেন থাকে না তাঁদের। অ্যাথলেটরা পান না দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রশিক্ষণ। এমনিতেই তাঁদের নেই কোনো স্পনসর। অলিম্পিক নিয়ে তাই খেলোয়াড়েরা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পান। আর এভাবেই যুগের পর যুগ চলছে। অলিম্পিকে বাংলাদেশ আদৌ কোনো পদক জিতবে কি না, তা যেন কোটি টাকার এক প্রশ্ন হয়েই থাকবে অনন্তকাল ধরে!

রোমান এ প্রশ্নই হাহাকারের মতো রেখে গেলেন এবারের টোকিও অলিম্পিকে!