অভিমন্যু মিশ্র যেদিন সবচেয়ে কম বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার রেকর্ড গড়ল, সেদিন অভিমানে আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমানের চোখে জল এসেছিল কিনা জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশের এই দাবাড়ুর এখনো গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব না পাওয়া নিয়ে তাঁর বাবা নজরুল ইসলামের আক্ষেপের কমতি নেই।
১ জুলাই বুদাপেস্টে একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে যখন গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পূরণ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের কিশোর অভিমন্যু, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর ৪ মাস ২৫ দিন! বাংলাদেশের দাবাড়ু ফাহাদের বয়স ১৮ বছর।
অভিমন্যুর মতোই কিশোর বয়সে ফাহাদের দাবার হাতেখড়ি এবং যেভাবে দাবার বোর্ডে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছিলেন একটা সময় পর্যন্ত, তাতে আরও আগেই ফাহাদকে দেশের ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে দেখেছেন অনেকে।
কিন্তু ঠিক কত দিনে গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পূরণ করতে পারবেন ফাহাদ, তা এখনো প্রশ্ন। বাংলাদেশও কবে ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার পাবে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই কারও।
বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন নিয়াজ। তখন গোটা এশিয়াতেই গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন মাত্র চারজন।
এরপর গত ৩৪ বছরে মাত্র চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন জিয়াউর রহমান। ২০০৬ সালে রিফাত বিন সাত্তার, ২০০৭ সালে আবদুল্লাহ আল রাকিব। সর্বশেষ গ্র্যান্ডমাস্টার ২০০৮ সালে পেয়েছে বাংলাদেশ, সেবার এই খেতাব পান এনামুল হোসেন রাজীব। অথচ পাশের দেশ ভারতে বর্তমানে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা ৬৭!
বাংলাদেশে দাবা কি শুধু–ই শখের খেলা? ঘরোয়া আড্ডা আর চায়ের দোকানেই কি শুধু খেলাটা জমে ওঠে? সত্যি বলতে, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে খেলাটার চর্চা একেবারেই উঠে গেছে। একটা সময় ছিল, টিফিনের ফাঁকে অন্যান্য খেলার সঙ্গে দাবার বোর্ডেও মগ্ন থাকত ছাত্রছাত্রীরা। সেই দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার পথে।
এদিকে প্রতিবেশী ভারত যেখানে দাবায় দিনে দিনে শুধু এগিয়েই যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ কোথায় পিছিয়ে?
ভারতে যে পরিমাণ গ্র্যান্ডমাস্টার তাদের পাইপলাইনেও আছেন প্রচুর দাবাড়ু। কিন্তু বাংলাদেশের পাইপলাইন ততটা সমৃদ্ধ নয়। ফাহাদের পর সুব্রত বিশ্বাস, নোশিন আঞ্জুমদের মতো প্রতিশ্রুতিশীলদের সংখ্যা হাতে গোনা। ১৩ বছর আগে বাংলাদেশ সর্বশেষ গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে। বাংলাদেশের পাইপলাইনের সংকট এ তথ্যেই পরিষ্কার।
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দেওয়া অস্থায়ী জায়গায় কোনো রকম ঘিঞ্জি পরিবেশে খেলতে আসেন দাবাড়ুরা। স্বাভাবিকভাবেই কোনো নতুন দাবাড়ু এসে সাদা কালো বোর্ডের প্রতি খুব বেশি আকৃষ্ট হবেন না।
বাংলাদেশে দাবাড়ু উঠে না আসার আরেকটি কারণ স্পনসরের অভাব। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিকের কথা বিবেচনা করলে মানতে হবে দাবা খেলার জন্য গভীর মনোযোগের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ, ‘প্রথম দেখায় দাবা খেলা যত সহজ মনে হয়, আসলে ততটা সহজ নয়। দাবা খেলার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি করতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা সময় দিতে হবে।’ প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের দাবাড়ুরা প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা নির্ভেজাল সময় দেওয়ার জন্য আর্থিক সহযোগিতা কি পাচ্ছেন?
নিয়াজ মোরশেদ যখন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন, তখন দাবার একটা উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল দেশে। কিন্তু সেই উন্মাদনা ফেডারেশন কাজে লাগাতে পারেনি। প্রতিবার বিশ্বকাপে যখন খেলতে যান বাংলাদেশের দাবাড়ুরা, দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার স্বপ্নও দেখতে পারেন না।
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দাবাড়ুদের রেটিং কম থাকার শাস্তি হিসেবে দেখেন ব্যাপারটা, ‘আমরা প্রথম রাউন্ডে কঠিন প্রতিপক্ষ পাই। কারণ, আমাদের রেটিং কম। আমরা ইউরোপের কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে পারি না। ঘরোয়া টুর্নামেন্টও কম আয়োজন হয়। তাই ভালো কিছু করতে পারি না বিশ্বকাপে গিয়ে।’ খেলতে হলে যে কোচের প্রয়োজন, সেটা দাবা ফেডারেশেনের যেন জানা নেই বললেই চলে। কোচের অধীনে খেলার সংস্কৃতি খুব কম দাবাড়ুরই আছে বাংলাদেশে।
আসলে সবচেয়ে বড় কথা, ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বাড়াতে হবে ফেডারেশনের। বেশি বেশি জিএম টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে এবং ইউরোপে খেলার ব্যবস্থা করতে হবে দাবাড়ুদের। তবেই রেটিং বাড়বে।
ভারতে স্কুল পর্যায়ে যে পরিমাণ দাবা চর্চা হয়, তা সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার। টুর্নামেন্টে জিতলেই অর্থ পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। আর দাবাড়ুদের জীবিকা নিয়েও খুব বেশি অনিশ্চয়তা থাকে না সেখানে।
বাংলাদেশে এসব নিশ্চয়তা কোথায়? এসব কালিঝুলি দূর হলেই না বিশ্বদাবায় উজ্জ্বল হবে বাংলাদেশের নাম।