প্রতিভা অন্বেষণ নেই, সংকটে নারী সাঁতার
২০১৬ সালের এসএ গেমসে প্রথম বাংলাদেশি নারী সাঁতারু হিসেবে সোনা জেতেন মাহফুজা খাতুন। তাঁর জোড়া সোনা জয়ের পর বাংলাদেশে মেয়েদের সাঁতার নিয়ে কিছুটা উন্মাদনা তৈরি হতেই পারত। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। আগামী বছর মার্চে পাকিস্তানে বসবে ১৪তম এসএ গেমসের আসর। কিন্তু গেমসের প্রস্তুতির জন্য যে নারী সাঁতারুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সোনিয়া আক্তার, মরিয়ম আক্তার, সোনিয়া খাতুন, ইরফানা খাতুন ও যুঁথি আক্তার—মাত্র পাঁচ সাঁতারু নিয়ে মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সে গত নভেম্বর থেকে চলছে মেয়েদের জাতীয় দলের ক্যাম্প।
ফেডারেশনের যথাযথ উদ্যোগের অভাবেই উঠে আসছে না নতুন নারী সাঁতারু। নেই তৃণমূল থেকে প্রতিভা অন্বেষণের কোনো কার্যক্রম। সেটারই প্রভাব পড়ছে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। নৌবাহিনী ও ফেডারেশনের যৌথ আয়োজনে সর্বশেষ প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি হয়েছিল ২০১৬ সালে। ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া ১৮ জন মেয়েকে তিন বছর ক্যাম্প করিয়েছে ফেডারেশন। সেই ক্যাম্প থেকে শুধু যুঁথি আক্তারই ডাক পেয়েছেন এবারের ক্যাম্পে। বাকিদের অনেকে বিভিন্ন কারণে সাঁতারই ছেড়ে দিয়েছেন।
সাঁতারে সামনে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক সূচি। মে মাসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, জুলাইয়ে কমনওয়েলথ গেমস, আগস্টে ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ও সেপ্টেম্বরে এশিয়ান গেমসে অংশ নেবে বাংলাদেশ। এসব প্রতিযোগিতায় পদক জেতার সম্ভাবনা না থাকলেও এসএ গেমসে সোনা জয়ের স্বপ্ন তো থাকেই। কিন্তু দিন দিন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সোনা জেতা তো পরে, নারী সাঁতারু খুঁজতে এখন রীতিমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতোই অবস্থা ফেডারেশনের।
সাঁতারু-সংকটের জন্য ফেডারেশনের অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করেছেন এসএ গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী ও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক সাঁতারু লায়লা নূর, ‘ফেডারেশন চলছে পরিকল্পনাহীনভাবে। “সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ” প্রতিযোগিতাটা ছিল সর্বশেষ প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো কোনো কর্মকর্তাই নেই ফেডারেশনে।’ তাঁর মতে, দেশে সাঁতার প্রতিযোগিতা নেই বলেই দেখা দিয়েছে নতুন সাঁতারুর অভাব, ‘বাইরের দেশে গেলে খুব খারাপ লাগে। দেখি চীনের সঙ্গে কীভাবে পাল্লা দিচ্ছে ভারত। অন্য দেশে যেখানে এ টিম, বি টিম, সি টিম আছে, সেখানে আমাদের সেই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটাই নেই।’
সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মাহফুজা রহমান বলেছেন, সিনিয়রদের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জুনিয়রদের দিকেই নজর দিতে হবে। কিন্তু সেই কাজটা হচ্ছে না। কম বয়সী নারী সাঁতারুদের সুইমিং কমপ্লেক্সে রেখে তাদের শিক্ষা, খাবার ও সঠিক অনুশীলনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। অভিভাবকদের সেই নিশ্চয়তা দিলে সাঁতারে পরিবর্তন আসবে। সাঁতার কোচ আমিরুল ইসলাম অবশ্য সাঁতারু-সংকটের আরেকটা কারণও দেখছেন, ‘আমাদের দেশে অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরাই সাঁতারে আসে। যাদের সর্বোচ্চ আশা থাকে নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, আনসারের চাকরি পাওয়া। চাকরি হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় দলে ভালো কিছু করার ক্ষুধা কমই থাকে।’
নারী সাঁতারুর অভাব যে দিনে দিনে এতটা প্রকট হয়ে উঠবে, সেটি নাকি বুঝতেই পারেননি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা বদরুল সাইফ। তবে তিনি মানছেন, ফেডারেশনের সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই এই সংকট, ‘সাঁতারু বাছাইয়ের কর্মসূচি আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। সেরা সাঁতারুর খোঁজের মাধ্যমে যাদের পেয়েছিলাম, তিন বছর তাদের ক্যাম্প করিয়েছি। কিন্তু করোনায় ক্যাম্প বন্ধ হওয়ার পর নানা কারণে অনেকে সাঁতার ছেড়েছে। সেটারই প্রভাব পড়ছে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। আমাদের এখন নতুন পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।’
ছয় বছর ধরে কেন প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি করেনি ফেডারেশন, সে প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর নেই তাঁর কাছে। তবে সংকট কাটাতে তাঁরা চেষ্টা করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি সাঁতারু আনতে, ‘জুনায়না আমাদের বিবেচনায় থাকবে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী দুই বাংলাদেশি সাঁতারুকে আনারও পরিকল্পনা আছে।’