‘আরও অনেক সেঞ্চুরি করবে লিটন’

লিটন দাসের মধ্যে অপার সম্ভাবনা দেখছেন নিল ম্যাকেঞ্জিছবি: এএফপি

২০১৮ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ দলের সাদা বলের ব্যাটিং–পরামর্শকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে ২০২০ সালের আগস্টে বিসিবির চাকরি ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে চোখ সরাননি নিল ম্যাকেঞ্জি। এবারের সিরিজে তো ধারাভাষ্যকক্ষ থেকেই দেখছেন পুরোনো ছাত্রদের পারফরম্যান্স। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ব্যাটসম্যান বলেছেন তাঁর চোখে দেখা বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে—

প্রশ্ন :

সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে দারুণ জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে হেরে গেল বাংলাদেশ। ম্যাচ দুটিতে দলের পারফরম্যান্সকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

নিল ম্যাকেঞ্জি: প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জয়টা ছিল অবিশ্বাস্য। তারা চাপটা খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছিল। ওই উইকেটে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শুরুতে উইকেট না হারানো। ছেলেরা দারুণ ব্যাটিং করে সেটাই করেছে। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল ভালো কিছু করবে। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে এখানে এসে বাংলাদেশের তিন শর বেশি রান করা অনেক বড় ব্যাপার। তবে পরের ম্যাচে ব্যাটিংটা ভালো হয়নি এবং সেটার বড় কারণ উইকেটের অসম বাউন্স।

নিল ম্যাকেঞ্জি যখন বাংলাদেশের ব্যাটিং পরামর্শক
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

আপনি একসময় বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচ ছিলেন। এবার বাংলাদেশের ব্যাটিংটা কেমন দেখছেন?

ম্যাকেঞ্জি: এখন পর্যন্ত সবাই খুব ভালো ব্যাটিং করেছে। প্রথম ম্যাচে দুই ওপেনার লিটন ও তামিমের ব্যাটিং দেখতে ভালো লাগছিল। উইকেটটা একটু থিতিয়ে আসার পর তারা বেশ কিছু ভালো শট খেলেছে। তবে লিটন যখন দ্রুত রান করে রানরেট বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করল, তখনই কেশব মহারাজ তাকে তুলে নিল। সাকিব যেটা খেলেছে, সেটা তো এক কথায় অবিশ্বাস্য! দারুণ সব শট খেলে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের ওপর রীতিমতো চড়াও হয়েছে সে। ইয়াসির আলী নিজের প্রতিভার পাশাপাশি বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং গভীরতাটাও দেখিয়ে দিয়েছে। সাকিবের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে সাহায্য করেছে সে। তার ইনিংসটাও ছিল দৃষ্টিনন্দন। দারুণ কিছু পুল শট খেলে নিজের সামর্থ্যটা দেখিয়েছে তরুণ এই ব্যাটসম্যান। আমার কাছে তার অন ড্রাইভগুলোও ভালো লেগেছে। আসলে ওই ম্যাচে সবার ব্যাটিংই ভালো হয়েছে। কয়েকটি ক্যামিও ইনিংস ছিল, যেটা কিনা বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের ছেলেরা এখন পাওয়ার হিটিংয়ের চর্চা করছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটা খুব ভালো সংযোজন। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে যে রকম উইকেট ছিল, সেটা ব্যাটসম্যানদের মূল্যায়ন করার জন্য আদর্শ নয়।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ দলের সঙ্গে থাকা অবস্থায় লিটনের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন আপনি। গত কয়েক সিরিজে অনেক পরিণত ব্যাটিং করেছেন তিনি। লিটনের ব্যাটিং–মানসিকতায় কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন এবার?

ম্যাকেঞ্জি: হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে যে লিটনের ব্যাটিং আগের চেয়ে অনেক পরিণত হয়েছে। এখন সে প্রায়ই তার ইনিংসগুলোকে এক শতে নিয়ে যেতে পারছে। লিটন একজন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, যে কিনা ম্যাচের ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ও যত বেশি খেলবে, যত বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, ততই তার ইনিংসগুলো লম্বা হবে। গত কয়েক মাসে লিটন বুঝিয়েছে, কীভাবে ইনিংসগুলোকে এক শ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়, সেটা সে জানে। আমার মনে হয়, ও তার ব্যাটিংয়ের প্রক্রিয়াটা ধরতে পেরেছে এবং উইকেটে গিয়ে নিজের গেমপ্ল্যান অনুযায়ী খেলতে পারছে। ওর খেলা দেখাটা সব সময়ই আনন্দের। একজন তরুণ ব্যাটসম্যানকে সমর্থন দিয়ে গেলে বিনিময়ে সে কী দিতে পারে, লিটন তার প্রমাণ। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের হয়ে লিটন আরও অনেক সেঞ্চুরি করবে।

দুই বছর বাংলাদেশ দলের সাদা বলের ব্যাটিং–পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন নিল ম্যাকেঞ্জি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

উইকেট একটু পেস–সহায়ক হলেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সমস্যায় পড়ে যান। যে কারণে দেশের বাইরের সিরিজগুলোয় ব্যাটিংয়ে সংগ্রাম করতে হয় তাঁদের। এ সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়?

ম্যাকেঞ্জি: বিদেশের মাটিতে ভালো ব্যাটিং এবং ম্যাচ জেতাটা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে শর্ট বল ও জোরে আসা বলগুলো সামলাতে পারেন তার ওপর। সেটার জন্য এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপটা যথেষ্ট অভিজ্ঞ বলেই আমি মনে করি। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলের তিন দীর্ঘদেহী পেস বোলারকে ঠিকভাবে গড়ে তোলা। উইকেটে জোরের ওপর বল ফেলার মতো পেসার দলে থাকলে কী হয়, সেটা নিশ্চয়ই আপনারাও দেখেছেন। বাংলাদেশের বোলাররা সাধারণত বল স্কিড করায়, যেটা বাংলাদেশের উইকেটের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে দীর্ঘদেহী পেসারদের আরও বেশি বাউন্স আদায় করে নিতে হবে। নিউজিল্যান্ডে ইবাদত যেটা করেছিল, বাংলাদেশের পেসারদের বিদেশের মাটিতে এ রকম পারফরম্যান্স আরও করতে হবে। টেস্ট জিততে হলে আপনাকে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নিতেই হবে। দীর্ঘদেহী পেসাররা যদি এসব উইকেটে তাদের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে শুরুতে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দিতে পারে, বাংলাদেশের স্পিনাররা এরপর কী করতে পারে, তা তো আমরা জানিই।

প্রশ্ন :

এ বছরই অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাবে বাংলাদেশ দল। তার আগে ব্যাটিং–প্রস্তুতিটা কেমন হওয়া উচিত?

ম্যাকেঞ্জি: অস্ট্রেলিয়ার উইকেট অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটের মতোই হবে। সেখানেও ব্যাটসম্যানদের প্রচুর শর্ট পিচ বল খেলতে হবে। আপার কাট, প্যাডেল বা হুক-পুল ভালো খেলেই সেসব সামলাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, ব্যাটের কানায় লাগা বলগুলো থেকে সব সময় বাউন্ডারি আসবে না। কখনো কখনো ক্যাচও হবে। মাঝব্যাটে বল লাগিয়ে আরও বেশি চার-ছক্কা মারার কৌশল জানাটা তাই অস্ট্রেলিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হবে। আপার কাট বা বানিয়ে শট খেলার অনুশীলনটা বেশি বেশি করে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। কারণ, ওই কন্ডিশনে এ রকম শর্ট খেলার পরিস্থিতিতে প্রায়ই পড়তে হতে পারে ব্যাটসম্যানদের।

বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে নিল ম্যাকেঞ্জি (ডানে)
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

শেষ প্রশ্ন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যালান ডোনাল্ড এই সিরিজেই বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পেস বোলাররা তাঁর কাছ থেকে কীভাবে উপকৃত হতে পারেন?

ম্যাকেঞ্জি: সন্দেহ নেই অ্যালান ডোনাল্ড একজন অভিজ্ঞ কোচ, তাঁর সময়ের একজন অন্যতম সেরা বোলারও। এর আগেও বাংলাদেশ দলে ভালো পেস বোলিং কোচ ছিলেন...ওটিস গিবসন, তাঁর আগে ছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। বাংলাদেশের পেস বোলিং লাইনআপও আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছে। মোস্তাফিজ কয়েক বছর ধরে ভালো বোলিং করছে। নতুন হিসেবে দলে এসে শরীফুল খুবই ভালো করছে। ভালো জায়গায় বল ফেলতে পারে ও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেকোনো উইকেটে ভালো লাইন খুঁজে পাওয়াটাই জরুরি। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আগে থেকেই ভালো কোচরা আছেন। অ্যালান ডোনাল্ডের ক্রিকেট–জ্ঞান আশা করি পেসারদের আরও সমৃদ্ধ করবে।