সাক্ষাৎকারে ল্যান্স ক্লুজনার
‘দুর্ভাগ্য, আমি এই যুগের ক্রিকেটার নই’
আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি কখনো না খেললেও ওয়ানডেটাই খেলতেন অনেকটা টি–টোয়েন্টির মতো করে। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ৫৩টি ঘরোয়া টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ১৩৬ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ১ হাজার ১৪, উইকেট নিয়েছেন ২৯টি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়ার আগেই খেলা ছেড়েছেন বলে, নইলে এখন হয়তো তাঁকে নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়িই লেগে যেত! হ্যাঁ, ল্যান্স ক্লুজনারের কথাই বলা হচ্ছে। বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের কোচ হয়ে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অলরাউন্ডার গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাঁর আফসোস আর টি–টোয়েন্টি দর্শনের কথা—
বাংলাদেশে এবার সময়টা কেমন কাটছে?
ল্যান্স ক্লুজনার: সময়টা ভালোই কাটছে। জৈব সুরক্ষাবলয় না থাকলে ভালো হতো। আমার কেনাকাটার খুব শখ। বাংলাদেশে এসে এর আগে দোকানপাট ঘুরে কেনাকাটা করার অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ্য ছিল। এবার সেটা হচ্ছে না। আশা করি পরেরবার যখন আসব, তখন পৃথিবী আরেকটু ভালো অবস্থায় থাকবে।
২০১৮ সালে রাজশাহী কিংসের কোচের ভূমিকায় কাজ করেছেন। আপনার দেখা বিপিএলটা আসলে কী রকম?
ক্লুজনার: বিপিএল কঠিন একটা টুর্নামেন্ট, বিশেষ করে বিদেশিদের জন্য। বিদেশি কোচদের জন্যও এটা চ্যালেঞ্জের। কারণ, বিপিএলে জিততে হলে স্থানীয় ক্রিকেটারদের ভালো করাটা জরুরি। বিদেশিদের অবদান থাকতে হয়, কিন্তু কন্ডিশনের কারণে স্থানীয়রাই ম্যাচ জেতায়।
খুলনা টাইগার্স দলে তো স্থানীয়রা ভালো করছে…
ক্লুজনার: হ্যাঁ, সৌম্য রানে ফিরেছে। মেহেদীর সঙ্গে এবারই প্রথম কাজ করা। ছেলেটা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সম্পদ হতে পারে। ইয়াসিরও ভালো করছে। তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটাও ভালো হয়েছে। খুলনার হয়েও ভালো খেলছে। এদের নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। আর মুশফিকের মতো ক্রিকেটার দলে থাকলে তো কাজটা সহজই হয়ে যায়। দারুণ ক্রিকেট–মস্তিষ্ক। ম্যাচের প্রতিটি অবস্থার সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিতে পারে।
ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে আপনিও টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। এই সংস্করণের তখন সবে শুরু। তখন কি ভেবেছিলেন এত অল্প সময়ে টি–টোয়েন্টি এতটা জনপ্রিয়তা পাবে?
ক্লুজনার: আমরা কেউ চিন্তাও করিনি এটা এতটা এগিয়ে যাবে। অনেকে হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন, কিন্তু টি-টোয়েন্টির কারণে ওয়ানডে এবং টেস্ট ক্রিকেটেও উন্নতি এসেছে। খেলার মান বেড়েছে, ক্রিকেটাররা এখন আগের তুলনায় ফিট। খেলায় অর্থ বাড়ায় পেশাদারত্বও বেড়েছে।
প্রশ্ন :
টি–টোয়েন্টি কীভাবে ওয়ানডে এবং টেস্টে উন্নতি আনল, সেটা কি আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?
ক্লুজনার: আশি-নব্বইয়ের দশকের তুলনায় এখন ওয়ানডে ম্যাচে গড়ে ৫০ রান করে বেশি হচ্ছে। টি-টোয়েন্টির কারণেই এটা হয়েছে। আগে কেউ ৩০০ রান তাড়া করার চিন্তাই করত না। এখন ৩০০ রানের ওয়ানডে ম্যাচকে ক্রিকেটাররা দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ভাগ করে ফেলে। প্রথম ২০ ওভারে ১৫০ রান, পরের ২০-এ ১৫০ রান—খেলা শেষ। টি-টোয়েন্টির বোলিং–ব্যাটিং দক্ষতাও বাকি দুই সংস্করণকে সমৃদ্ধ করছে। নতুন শট, ডেলিভারি দেখছি। গত কয়েক বছরে টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়াগুলো নিশ্চয়ই দেখেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলছে দলগুলো। এসব এসেছে মূলত টি-টোয়েন্টি থেকে।
প্রশ্ন :
এ যুগের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটাররা যা করছেন, আপনি সেটা নব্বইয়ের দশকেই করেছেন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে আপনার ছক্কা মারার অনুশীলন দেখে পন্টিং-ওয়াহরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সে রকম অনুশীলন তো এখন সবাইকে করতে দেখা যায়...
ক্লুজনার: ক্রিকেটাররা আগে কেন এ অনুশীলন করেনি, সেটাই আমাকে অবাক করে। এটা বুঝতে এত দিন লাগল কীভাবে কে জানে (হাসি)! আমি যে মুহূর্তে ব্যাটিংয়ে নামতাম, তখন কাভার ড্রাইভ নয়, ছক্কা মারাটাই ছিল আসল। আপনাকে বুঝতে হবে কত জোরে মারতে হবে, কোন দিকে মারতে হবে, বাতাস কোন দিকে বইছে এবং কীভাবে মারতে হবে। অনুশীলন না করলে এসব কীভাবে বুঝবেন?
প্রশ্ন :
নব্বইয়ের দশকের সেই দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাঠামোটাকেই তো এখন আদর্শ টি-টোয়েন্টি দলের কাঠামো ধরা হয়। তিন-চারজন অলরাউন্ডার, লোয়ার অর্ডারে জোরে মারার মতো ব্যাটসম্যান...
ক্লুজনার: কাগজ–কলমে দল গড়তে চাইলে সবাই আমাদের মতো অলরাউন্ডারদেরই নিতে চাইবে। কিন্তু সব সময় তো প্রত্যাশিত দক্ষতার ক্রিকেটার পাওয়া যায় না। আমরা অলরাউন্ডারদের দল ছিলাম, কারণ আমাদের সেই রকম ক্রিকেটার ছিল। আমরা ৬-৭ জনকে দিয়ে ১০ ওভার বল করাতে পারতাম। এ বিলাসিতার সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না। টি-টোয়েন্টিতে আপনি এমন ক্রিকেটারই তো চাইবেন।
প্রশ্ন :
যদি এ যুগের খেলোয়াড় হতেন, তাহলে তো আপনিও অনেক ধনী ক্রিকেটার হতেন...
ক্লুজনার: সত্যি তাই। আমি এই প্রশ্নটা সব সময় শুনে থাকি। একবার ভেবে দেখুন আমাদের সময় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট থাকলে আমরা কত টাকা আয় করতাম! তবে সময়ের ওপর তো কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। দুর্ভাগ্য, আমি এ যুগের ক্রিকেটার নই। তবে এক দিক থেকে ভাগ্যবান—আমি এখন কোচ হিসেবে খেলাটার সঙ্গে আছি।
প্রশ্ন :
ভবিষ্যতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কোন দিকে যেতে পারে?
ক্লুজনার: এটা বলা মুশফিল। তবে পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছে। খেলাটাও বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিছুদিন আগে আমি টি-টেনে কাজ করেছি। দেড় ঘণ্টার খেলা, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি ২২ গজ থেকে চোখ সরাতে পারবেন না। প্রতিটি বলেই কিছু না কিছু ঘটছে। পৃথিবীটা যেভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে, টি-টেন যেন সে রকমই। ইংল্যান্ডে ১০০ বলের খেলা দেখলাম। সেটাও রোমাঞ্চকর। ভবিষ্যতে হয়তো টি-টোয়েন্টিরই নানা বৈচিত্র্য দেখতে পাব।